![]() |
গল্প - অনেক সাধনার পর (১ম পর্ব) অনন্য শফিক |
ডাক্তার সাঈদ মুরসালিন এই হসপিটালের কোন দায়িত্বরত ডাক্তার নন। তিনি অবশ্য ময়মনসিংহ বিভাগের শিশু বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ডাক্তার। দায়িত্বরত নার্স তাকেই ফোন করেছিল। তিনি এসেছেন সঙ্গে সঙ্গে। এসে দেখেন আমরা কাঁদছি। আমার রাজকন্যা চোখ মুখ উলটে দিচ্ছে।ডাক্তার সাঈদের কাছে আমি অনুনয় বিনয় করে বললাম,'আল্লার দোহাই লাগে আপনি আমার মেয়েকে বাঁচান স্যার!'
ডাক্তার সাঈদ বললেন,'অস্থির হবেন না আপনি!আমি দেখছি।'
এরপর তিনি আমার মেয়ের গায়ে হাত দিলেন।নার্ভ চেক করলেন।ব্যাগ থেকে বের করে কী একটা ইনজেকশন দিলেন। ইনজেকশন দেয়ার মিনিট পাঁচেক পড়েই মেয়ে আমার ঘুমিয়ে পড়লো।
আমি তখনও ভয় পাচ্ছি।ভাবছি এটা কী কোন স্বাভাবিক ঘুম?
ডাক্তার সাঈদ আমায় অভয় দিলেন। বললেন,'আর কোন চিন্তা নাই।মেয়ে সুস্থ এখন।'
এরপর নার্সের সাথে কী বলে যেন ডাক্তার সাঈদ চলে গেলেন।আমি তখন নার্স আপুকে ধন্যবাদ দিলাম। ধন্যবাদ দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,'আচ্ছা আপু সাঈদ স্যার তো অনেক বিজি মানুষ।রোগী দেখেই কুলিয়ে উঠতে পারেন না।উনি আপনার একটা মাত্র ফোন কলেই চেম্বার থেকে সঙ্গে সঙ্গে যে এসে পড়লেন?উনি আপনার কে হোন?'
নার্স আপু হাসলেন। হেসে বললেন,'সাঈদ
আমার হাসব্যান্ড।'
আমি এই কথা শুনে ভীষণ রকম অবাক হয়েছি। অবাক হওয়ার কারণ হলো একজন নার্সকে উনি বিয়ে করেছেন?অথচ উনার যা নাম ডাক!যা অর্থ বিত্ত এবং সম্মান!তার জন্য কী আরেকটি ডাক্তার মেয়ের অভাব ছিল?
হতে পারে তিনি নার্স আপুকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। ভালোবাসা এমন-ই।ধনী গরীব রুপ গুণ দেখে হয় না।
আমি এক পর্যায়ে নার্স আপুকে বললাম,'আপু আপনি অনেক বড় ভাগ্যবতী!'
কথাটা শুনে হাসলেন না নার্স আপু। বরং চোখ থেকে দু ফোটা জল ফেলে দিলেন।আমি অবাক হলাম। আচ্ছা উনারও কী আমার মতো পারিবারিক কোন সমস্যা?
ভালোবেসে বিয়ে করেছেন কিন্তু এখন অসুখী?সাঈদ স্যার অন্য কোন নারীতে আসক্ত?
এখন তো কতোই এমন হয়!ভুরি ভুরি দেখেছি। আমার নিজের ঘরেই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ।শুভর চেয়ে ভালো ছেলে আমার জীবনে আমি দেখিনি। কিন্তু সে-ই গোপনে কত কী করে ফেললো!
আমাকে জিজ্ঞেস করতে হলো না এসব।নার্স আপুই নিজ থেকে বললেন। বললেন,'গত পাঁচ মাস আগে তার একটি ছেলে সন্তান মারা গেছে।তাও জন্মের এক সপ্তাহ পর। আমার মেয়ের মতো খিঁচুনিতেই।ডাক্তার সাঈদ ঢাকায় ছিলেন।একটা ট্রেনিংয়ে।আর এদিকে তার ছেলের শুরু হলো খিঁচুনি। তাড়াহুড়ো করে হসপিটালে নিয়ে এসেছিল ছেলেকে নার্স আপু। কিন্তু কাজ হয়নি। ইনজেকশন দেয়ার আগেই ছেলে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল ওপারে!'
আমি নার্স আপুকে সান্তনা দিলাম।আর বুঝতে পারলাম উনি বোঝেন সন্তানের মৃত্যু কতোটা ভয়াবহ!বোঝেন বলেই সঙ্গে সঙ্গে স্বামীকে ফোন করে আনিয়েছিলেন এখানে।স্বামীও সঙ্গে সঙ্গে এসেছেন।কারণ সেও যে সেই এখই দুঃখে দুঃখী!
সন্তান হারা!
'
মা বাসায় গিয়েছেন পরদিন।আমায় সাথে নেননি।আরো দু'দিন এখানে থাকতে হবে আমার। যদিও আমি চলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মা বলেছেন বাসার পরিস্থিতি বৈরী। আগে তিনি ওই মেয়েকে বাসা থেকে বের করবেন। তারপর আমার বাসায় যাওয়া। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো অর্ণাকে কিছুতেই বাসা থেকে বের করা গেলো না।ওর হাতে বিয়ের ডকুমেন্ট আছে। তাছাড়া তার পেছনে লোক বলও আছে।অর্ণা সরাসরিই বলেছে, তাকে এই বাড়ি থেকে তাড়াবার চেষ্টা করলে সে ভয়ংকর কিছু করবে। পুলিশ নিয়ে আসবে বাড়িতে। তাছাড়া তার পক্ষে অবস্থান করবে আমার শ্বশুরের রেখে যাওয়া ব্যবসায়ী প্রতিদ্বন্দ্বীরাও!মামলা টামলা করে একটা নাজুক অবস্থার সৃষ্টি করবে মেয়েটা।আর সবচেয়ে বড় কথা হলো ওই মেয়ের পেটে আবার শুভর সন্তান।এটাই বড় শক্তি তার।শুভও মেয়েকে এ বাড়িতেই রাখবে।মা অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যেতে লাগলো।শেষে তিনি চুপ হয়ে গেলেন। এবং হসপিটালে আমায় নিতে এসে বললেন,'মাগো, পরিস্থিতি ভালো না মোটেও।ক'দিন যাক। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আপাতত এ নিয়ে কিছু করা যাবে না। তোমাকে কদিন একটু সহ্য করতে হবে।'
আমি বললাম,'কেন মা?'
তিনি সবকিছু খুলে বললেন।
'শত্রুরা ওৎ পেতে আছে। সুযোগের অপেক্ষা করছে ওরা।আমি ওদেরকে সেই সুযোগ করে দিতে পারি না!'
আমার কষ্ট লাগছে খুব।আমি জানি এমন পরিস্থিতিতে বাসায় থাকা আমার জন্য কতোটা কষ্টের! তবুও বললাম,'মা চলুন।আমি পরিস্থিতি সামলে নেবার চেষ্টা করবো।'
মা আমায় অভয় দিলেন। বললেন,'ভয়ের কিছু নাই।আমি থাকতে তোমার হাতেই এ বাড়ির রাজত্ব। এছাড়া ওই অর্ণা না ফর্ণা তাকে আমি যে করেই হোক এ বাড়ি থেকে বের করবোই।'
আমি বললাম,'আচ্ছা।'
'
আমি ভেবেছিলাম অর্ণা বোধহয় এ বাড়িতে ভয়ে ভয়ে থাকবে। চুপচাপ থাকবে। কোনমতে এ বাড়ির আশ্রিতা হবে। কিন্তু আমার ভাবনা হলো উল্টো। বাসায় ফিরে দেখি আমার ঘরেই অর্ণা তার রাজশয্যা সাজিয়ে বসে আছে। এই ঘর এখন তার দখলে।আমি ঘরে ঢুকতে চাইতেই সে বাঁধা দিলো।বললো,'এই ঘরে না।অন্য ঘরে যাও।এ ঘর এখন থেকে আমার।'
ওর এমন স্পর্ধা দেখে আমি রাগে কাঁপতে শুরু করলাম।মাও আমার পাশে। কিন্তু তিনি চুপচাপ।
আমি ওকে বললাম,'থাপরিয়ে সবগুলো দাঁত ফেলে দিবো ফাজিল মেয়ে।উড়ে এসে জোড়ে বসেছে যেন!ভালোয় ভালোয় এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাও বলছি। নয়তো--'
আমার মুখ থেকে কথাটা টেনে নিলো অর্ণা। তারপর সে বললো,'নয়তো কী?কী নয়তো? আমার হাসব্যান্ডের ঘরে এসে আমায় হুমকি দেয়া হচ্ছে?'
মা তখন ধমক দিলেন অর্ণাকে। বললেন,'কিসের হাসব্যান্ড ? নষ্ট মেয়ে কোথাকার!
অত সাহস কে দিয়েছে তোমায় হ্যা?ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিবো এক্ষুনি!'
অর্ণা হাসলো। হেসে বললো,'এই বাড়ি কী আপনার? আপনার নামে লিখা?'
মা উঁচু গলায় বললেন,'এইটা তোমার জেনে কী লাভ এই বাড়ি কার নামে লিখা?'
অর্ণা আবার হাসলো। হেসে বললো,'আমার হাসব্যান্ডের নামে লিখা। সো, গলাটা একটু নামিয়ে কথা বলবেন। বুঝেছেন?'
মা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন এবং ওর গালে চড় বসিয়ে দিতে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু চড় দিতে পারলেন না। ঠিক তখন এসে ঘরে উপস্থিত হয়ে গেল শুভ। এবং মায়ের হাতটা খপ করে ধরে ফেললো সে।মা তাজ্জব বনে গেলেন একেবারে। কিছু বলতে যাবেন তিনি এর আগেই শুভ বলে উঠলো,'আমার স্ত্রীকে শাসন করার একমাত্র আমার একার অধিকার আছে।আর কারোর কোন অধিকার নাই!'
মা কেঁদে ফেললেন। কেঁদে কেঁদে তিনি বললেন,'এসব কী বলছিস শুভ তুই?'
শুভ বললো,'তোমরা যদি জল আরো ঘোলাটে করতে চাও তবে আমিও কিন্তু ভয়ংকর হবো মা।'
মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন,'তোকে না আমি জন্ম দিয়েছি।তুই এমন চরিত্রহীন হলে কী করে রে শুভ?'
শুভ বললো,'হ্যা দিয়েছো। কিন্তু আমি চরিত্রহীন নয়।'
'নষ্ট একটা মেয়ে নিয়ে ঘরে উঠেছিস তবুও বলছিস তুই চরিত্রহীন নয়?'
শুভকে কোনদিন রাগান্বিত অবস্থায় দেখিনি আমি।আমি ভাবতাম এই লোকটা একটা মাটির মানুষ। সহজ সরল।রাগ জিনিসটা তার রক্তে আদৌও নাই। কিন্তু আজ ভয়ংকর রাগ দেখাচ্ছে সে।মার দিকে চোখ লাল লাল করে তাকিয়ে বললো,'মা আরেকবার যদি অর্ণাকে নিয়ে তুমি কুরুচিপূর্ণ কোন কথা বলো তবে আমিও কিন্তু তোমার সাথে ভালো আচরণ করবো না বলে দিলাম!'
মা অবাক হলেন। এবং ঘাবড়ে গেলেন। তিনি অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললেন,'কী করবি তুই?আমার গায়ে হাত তুলবি?'
শুভ এরপর মাকে কী বললো তা শুনতে পাইনি আমি আর।কারণ ও ঘরে মেয়েকে শুইয়ে রেখে এসেছিলাম আমি। হঠাৎ এমন চিৎকার শুরু করলো মেয়ে! দৌড়ে গেলাম মেয়ের কাছে। ওকে যতোক্ষণে শান্ত করলাম ততক্ষনে দেখি মা আবার বোরকা পরেছেন।দু হাতে দুই ব্যাগ। আমার কাছে এসে ব্যাগ দুটি মাটিতে রেখে আমার কাছ থেকে আমার মেয়েকে কোলে নিলেন তার। তারপর আদর করে চুমু খেয়ে আবার আমার কোলে উঠিয়ে দিয়ে বললেন,'মা,কতো সময় কতো কথা বলে ফেলেছি তোমায়। আমার প্রতি কোন রাগ রেখো না!'
কথাগুলো বলতে গিয়ে তিনি চোখ মুছলেন।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,'এসব কী মা? আপনি কোথায় যাচ্ছেন?'
মা বললেন,'বাপের বাড়ি।বাপ তো নাই। ভাইয়ের ঘরে গিয়ে উঠি।'
বলে শব্দ করেই কেঁদে উঠলেন তিনি।
আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না।মার সাথে কাঁদতে শুরু করলাম। কাঁদতে কাঁদতে বললাম,'মা, আপনি চলে যাচ্ছেন কেন? আপনি না বললেন এ বাড়ি থেকে ওদের তাড়িয়ে দিবেন?'
মা বললেন,'মেয়েদের হাতে যে অত বড় ক্ষমতা নাই গো মা! এই বাড়ি তো আর আমার নামে না। ছেলের নামে।আমি এতো দিন ভাবতাম আমার ছেলেই আমার সম্পদ। কিন্তু এখন দেখি সে-ই আমার না।চলে যেতে বলেছে আমায়। এখানে থাকলে নাকি আমার চুপচাপ থাকতে হবে।ওর বিরুদ্ধে টু শব্দও করা যাবে না।যদি এভাবে না থাকতে ইচ্ছে করে তবে নাকি আমার জন্য সব সময় দোয়ার খোলা আছে।চলে যেতে বলেছে আমায়!'
মা শব্দ করে কাঁদছেন। আবার ব্যাগ দুটো হাতে উঠিয়ে নিয়েছেন তিনি।
আমি বললাম,'আমিও যাবো মা। আমিও যাবো আপনার সাথে।'
তিনি বললেন,'না। আমার নিজেরই কোন ঠিক ঠিকানা নাই। ভাইয়ের বাড়িতে আমি নিজেই আশ্রিতা হয়ে থাকবো।কী জানি আমায় ওরা রাখে কি না!দিন পাল্টেছে এখন। নিজের ছেলেই ঘরে রাখে না।ভাই এখন বৃদ্ধ। ছেলেদের হাতেই সব দায়িত্ব।কী জানি ওরা আমায় রাখে কি না!
যেখানে আমার নিজের পায়েই মাটি নেই সেখানে তোমায় সাথে করে নেই কী করে গো মা?তুমি থাকো। আল্লাহ তোমার প্রতি অবশ্যই সদয় হবেন।'
মা চলে গেলেন।মা চলে যাওয়ার সময় শুভ ঘরেই ছিলো।সে তখন টু শব্দটি পর্যন্ত করলো না। তাকিয়ে দেখলোও না পর্যন্ত
আমিই তখন চিৎকার করে বললাম।
'আল্লাহ গজব নাজিল করবেন। আল্লাহ অত সহজে ছেড়ে দিবেন না এই পাপের জন্য!'
আমার কথা শুনে শুভ আর অর্ণা উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করে দিলো।তারা যেন খুব মজা পাচ্ছে এতে!
আর আমি তখন রাগে------
আর আমি তখন রাগে শুভকে বললাম,'তুমি বুঝতে পারছো না ঠিক কার পাল্লায় যে পড়েছো!ও মানুষ না শয়তান একটা।তোমায় ধ্বংস করে ছাড়বে দেইখো ও! সবকিছু ও শেষ করে দিবে।ও একটা ছলনাময়ী।ও ভালোর জন্য এই বাড়িতে ঢুকেনি শুভ!'
অর্ণা তখন গাল ফুলিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে সে শুভকে বললো,'দেখেছো আমাকে নিয়ে কত বাজে বাজে কথা বলছে ও! তুমি কী ওকে এর জন্য কোন পানিশমেন্ট দিবা না শুভ? তুমি যদি কোন পানিশমেন্ট না দেও তবে আমি বুঝবো ওর জন্যই তোমার সব দরদ। আমার জন্য তোমার কোন দয়া মায়া ভালোবাসা নাই।আমায় তুমি তোমার ঘরের দাসি বাদীই মনে করো!'
শুভ হঠাৎ চোখ গরম করে আমার দিকে এগিয়ে এলো তখন।অর্ণাকে সে ভীষণ রকম ভালোবাসে,অর্ণার প্রতি তার ভীষণ মায়া এটা দেখাতে গিয়ে আমার গালে শক্ত দুটো চড় বসিয়ে দিলো। তারপর ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বললো,'এ বাড়িতে থাকতে হলে চুপচাপ থাকতে হবে।কথা বললেই আউট করে দিবো। এটাই আমার লাস্ট ওয়ার্নিং।'
আমি তখন আর দশটা মেয়ের মতো চুপ করে থাকলাম না। যদিও আমার তখন খারাপ লাগছে। এমনিতেও শরীর দূর্বল!
তবুও আমি ওর দিকে গলা বড় করে বললাম,'আমায় মেরে ফেললেও আমি চুপ করে থাকবো না। এই মেয়ে তোমার সব শেষ করে ছাড়তে এসেছে। কিন্তু আমি তা হতে দিবো না। আমার সোনার সংসার এভাবে আমি শেষ হয়ে যেতে দিবো না।'
অর্ণার কান্না তখন আরো বাড়লো।
আর শুভ তখন আমার সামনে এসে ধমক দিয়ে বললো,'ফকিরনির মেয়ে কোথাকার! তোর সোনার সংসার?তোর বাপের টাকায় করেছি এসব নাকি রে?তোর বাবাই তো আমার বাবার উপর নির্ভর করে থাকতো। কদিন পর পরেই হাত পেতে ভিক্ষে নিতো!আসলে তোরে বিয়ে করাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। তুই যদি আরেকবার অর্ণাকে নিয়ে কোন কথা বলিস তবে আমি তোর জন্য ভয়ংকর রুপ ধারণ করবো কিন্তু! এই বলে দিলাম শেষবার।'
আমার ভীষণ খারাপ লাগছে বাবাকে নিয়ে এসব বলায়।আমি জানি আমার বাবা মোটেও এরকম মানুষ ছিলেন না। কারোর কাছ থেকে হাত পেতে এক পয়সা নেয়ার মানুষ না। শেষ বয়সেও গ্রামের ছেলে মেয়েদের প্রাইভেট টিউশনি করিয়ে অল্পবিস্তর যা কিছু পেয়েছেন তা দিয়েই পরিবারের খরচ চালিয়েছেন।তাই এটা মেনে নিতে না পেরে আমি বললাম,'এই মেয়ের জন্য আমার বাবার নামে এসব মিথ্যে মিথ্যে অপবাদ দিলে তুমি! ছিঃ! ওই মেয়ে যে একটা ডাইনি তা তুমি এখনও বুঝতে পারোনি। কিন্তু খুব দ্রুত সব টের পাবে তুমি। কিন্তু ততক্ষণে তোমার সবকিছু শেষ করে ছাড়বে ও!'
এরপর শুভ আমার দিকে অনেকক্ষণ ধরে চোখ গরম করে তাকিয়ে থেকে দাঁত কটমট করতে লাগলো। তারপর কী ভেবে যেন রাগে আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার গলা থেকে এক টানে এক সপ্তাহ আগে ওর দেয়া চেনটা খুলে নিয়ে ঘরের ভেতর চলে গেল।আমি ওখানেই অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থেকে চোখের জল ফেললাম। তারপর ঘরে এসে মেয়েকে কোলে টেনে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে কাঁদতে শুরু করলাম।
মেয়ে তখন কী বোঝেছে কে জানে!আমি যখন কাঁদছি সে তখন একেবারেই নিশ্চুপ। শুধু চোখ বড় বড় করে বড়দের মতো করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছে।
'
সেদিন সন্ধ্যা বেলায় হুট করে আমাদের বাসার বুয়া নাসরিন আমার কাছে এসে বললো,'আফা,আফনের কী কী ব্যাগ পত্তর গোছায়বেন সব গোছায় ফেলেন।অর্ণা আফা বলছে আফনের কোন জিনিস এই বাড়িতে রাখা যাইবো না!'
আমি ওর কথা বুঝতে পারছি না।তাই ওকে এক প্রকার ধমক দিয়েই বললাম,'কী বলো ক্লিয়ার করে বলা যায় না?আমি বুঝতে পারিনি তুমি কী বলছো। এখন স্পষ্ট করে বলো।'
নাসরিন কিছু বলার আগেই আমার ঘরে অর্ণা চলে এলো। এবং এসে একটা চেয়ার টেনে বসে বললো,'তোরে আজকে ডিভোর্স দেয়া হবে।আর আগামীকাল ভোরবেলা ড্রাইভার তোরে তোর বাপের বাড়িতে রেখে আসবে গিয়ে। এখন ক্লিয়ার হয়েছে তো বিষয়টা?'
আমি অর্ণার এই কথাগুলো হজম করতে পারিনি।তাই রেগেমেগে আগুন হয়ে অর্ণার কাছে এসে অর্ণার গালে একটা চড় বসিয়ে দিলাম।শুভ তখন বাসায় ছিল না।অর্ণা চড় খেয়ে তখন পাগলের মতো শুভকে ফোন দিয়ে কেঁদে কেঁদে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,'তোমার বাসার চাকরানীটা আমায় মেরেছে।আরেকটু হলে মেরেই ফেলতো একেবারে। তুমি এক্ষুনি বাসায় আসো।না জানি কখন আবার আমায় মেরে টেরে ফেলে।একা একা আমার ভীষণ ভয় করছে!'
তারপর ফোন রেখে দিলো অর্ণা।
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,'এসব কী বানিয়ে বানিয়ে বলছো তুমি ওর কাছে?ডাইনি মেয়ে একটা!'
অর্ণা হাসলো। হেসে বললো,'অপেক্ষা করো। তোমার দিন আজকেই শেষ।'
'
শুভর ফিরতে খুব একটা দেরি হলো না!
সে ফিরতেই ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো অর্ণা। তারপর কাঁদতে শুরু করলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,'আমি এখানে থাকতে পারবো না শুভ।ও মেরে ফেলবে আমায়!'
ওর সঙ্গে তখন গলা মিলিয়ে বাসার বুয়া নাসরিনও ঠিক একই কথাই বললো।
সে ইনিয়ে বিনিয়ে বললো,'ছার,তৃষা আফা অর্ণা আফারে আরেকটু হইলে মাইরেই ফেলতো! ভাগ্য ভালো আমি ফিরাইতে পারছিলাম!'
শুভ থম মেরে খানিক সময় দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আমায় উদ্দেশ্য করে বললো,'তোর জন্য কাগজ পত্র রেডি হচ্ছে।দু একদিনের ভেতর ডিভোর্স পেপার পেয়ে যাবি। তখন সাইন করে দিস ওটায়।আর এখন তুই আমার বাড়ি ছাড়বি। তোর জন্য এই বাড়ির দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ।ড্রাইভার ফখরুল এখন তোকে দিয়ে আসবে তোর বাবার বাড়িতে গিয়ে।'
আমি শুভর কথাগুলো শুনে সত্যিই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। এবং শুভকে বললাম,'এসব কী বলছো তুমি শুভ? পাগল হয়ে গেছো নাকি?'
আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম।ওর সামনে।ওর একটা হাত ধরতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ও ঝাঁকুনি দিয়ে হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,'তোমার সাথে আমার সকল সম্পর্কের অবসান হলো এখানেই। আমার মেয়েকে তুমি লালন পালন করে বড় করে দিবে। বিনিময়ে তার সব খরচ সহ তোমায় মান্থলি একটা স্যালারি দিবো আমি!'
আমি কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। এমন সময় কী বলা যায়?
শুধু রাগে দুঃখে এটুকু বললাম,'আমার মেয়েকে তোমার মতো পাপী কোন পিতার একটা পয়সা খাইয়েও বড় করবো না আমি। এই মেয়ে কোনদিন তোমার নাম পর্যন্ত জানবে না!ও জানবে ওর শুধুমাত্র মা আছে।বাবা নাই!'
শুভ কথা বললো না।তার মেয়েকে নিয়ে কোন রকমের আক্ষেপ নেই।সে অর্ণার মোহে অন্ধ। অন্ধ হয়ে গেছে বলেই কী করছে না করছে কিছু বুঝতে পারছে না।
শেষমেষ আমাকে সে রাতেই ও বাড়ি ছাড়তে হলো।গাড়ি করে ফখরুল এসে দিয়ে গেল আমার বাবার বাড়িতে। এখন অবশ্য এটাকে বাবার বাড়ি বললে ভুল হবে।যেহেতু বাবা মারা গিয়েছেন ছ'মাস আগে।মা আছেন। তিনি কোনমতে জীবন পাড় করছেন কষ্ট ক্লেশে।তার সাথে আমার এক মামাতো ভাই থাকে।নাহিন।আট বছর বয়স ওর।মামী মারা গেছেন ক্যান্সারে। এরপর থেকেই মামা পাগল। পাগল হয়ে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেলেন। এরপর থেকেই নাহিন আমাদের বাড়িতে।
হুট করে এতো রাতে এভাবে আমায় বাড়িতে আসতে দেখে মা চমকে গেলেন। অবাক হয়ে আমায় বললেন,'কী রে অত রাতে যে?তাও এই কাঁচা শরীর নিয়ে!'
আমি সঙ্গে সঙ্গে মাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম।
মা বললেন,'কী হয়েছে রে মা?কী হয়েছে তোর?'
আমি কাঁদতে কাঁদতেই বললাম,'সবকিছু শেষ হয়ে গেছে মা। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।'
তারপর সবকিছু খুলে বললাম।
মা শোনে তিনিও কাঁদতে লাগলেন। কিন্তু কী করবেন তিনিও বুঝতে পারছেন না। আমার মা আর দশজন মায়ের মতো নন। তিনি শক্ত পোক্ত ধরণের মহিলা।বিপদ থাকে সহজে টলে দিতে পারে না। তিনি আমায় সান্তনা দিয়ে বললেন,'ভাগ্যে যা লিখা আছে তাই হবে মা। ওখানে না থেকে ভালো হয়ছে। চরিত্রহীন মানুষের সাথে থাকার চেয়ে একা একা সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা অনেক ভালো!'
আমি কাঁদতে কাঁদতে মার আঁচলে মুখ লুকোলাম।আর আমার আঁচলে মুখ লুকোলো আমার মেয়ে। সেইদিন থেকেই আমাদের সংগ্রাম শুরু হলো। আমাদের মা মেয়ের। আমার মায়ের আমার আর আমার মেয়ের।
অনন্য শফিক
Post a Comment
কমেন্টে স্প্যাম লিংক দেওয়া থেকে বিরত থাকুন