গল্প - অনেক সাধনার পর (১ম পর্ব) অনন্য শফিক


'আপনি সৌরভ স্যারের ওয়াইফ তৃষা মেডাম তাই না?'
আমি খানিক চমকে উঠলাম। ফোনের ওপাশ থেকে যে গলা শোনা যাচ্ছে তা মাঝ বয়েসী কোন পুরুষের। তবে তার কন্ঠে যথেষ্ট পরিমাণ রাগ!

আমি সাধারণ গলায় বললাম,'জ্বি আমি তৃষা। আপনি কে?'
'আমার পরিচয় জানার কোন দরকার নাই মেডাম।আপনারে একটা স্বতর্ক বাণী দিতে ফোন করছি। আপনি কথা না বলে চুপ করে শোনেন!এতে আপনার মঙ্গল।'
মাঝ বয়সী লোকটির এই কথায় আমি সত্যিই ঘাবড়ে গেছি। তবুও নিজেকে শক্ত রাখার ভান করে বললাম,'জ্বি বলুন আপনার স্বতর্ক বাণী।আমি চুপ করেই শুনছি!'
লোকটি এবার বলতে শুরু করলো।সে বললো।
'আপনার হাসব্যান্ড শুভ স্যার রোজ আমার হোটেলে দুপুর বেলা একটা মেয়ে নিয়ে আসে। সুন্দরী মেয়ে। দেখতে মডেল মডেল লাগে।তারা আমার হোটেলে এসে দুই আড়াই ঘণ্টা থাকে। তারপর চলে যায়। অবশ্য বিনিময়ে আমারে মোটা অঙ্কের টাকাই দেয়।'
এসব কী বলছে লোকটা!আমি যখনই জিজ্ঞেস করতে যাবো চাচা আপনার হোটেলের কী নাম তখনই ওপাশ থেকে ফোন কেটে দিলো লোকটি। এরপর আমি বার কয়েক ডায়েল করলেও কাজ হলো না। ফোনের সুইচ একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে।

আমার এবার বুক ধরপড় করছে।বাবু পেটে আসার সাত মাস হলো।ডাক্তার বার বার নিষেধ করেছেন কোন রকম টেনশন না করতে! ওদিকে আমার শাশুড়িও আমায় কাজ টাজে হাত দিতে দেন না।শুভও আমায় কেয়ার করে।এই তো গত শুক্রবারে বারান্দায় বসে আমার হাত পায়ের নখ কেটে দিলো।চুলে তেল দিয়ে আঁচড়ে দিলো।রাতে হঠাৎ তেষ্ঠা পেলে সে চট করে বিছানা থেকে উঠে গ্লাস ভরে পানি এনে আমার ঠোঁটের সামনে ধরে।আর এমন একটা মানুষ সম্পর্কে কী বাজে কথাগুলোই না বললো মাঝবয়সী বেয়াদব লোকটা!
আমার ভীষণ রাগ লাগছে ওই লোকটার প্রতি! ওকে যদি আমি চিনতাম তবে মুখের উপর দুটো শক্ত বকা দিয়ে আসতাম। আমার মনে হয় এই লোকটা আমার শ্বশুরের পুরনো কোন শত্রু! আমার মরহুম শশুর ধনবান ছিলেন। অনেক গুলো মিল কারখানা তিনি রেখে গেছেন। সেই সাথে রেখে গেছেন তার সাথে ব্যবসায়ী প্রতিযোগীতায় হেরে যাওয়া এক পাল শত্রুও।ওরা বাইরে কিছু করতে না পেরে এখন ঘরে ঢুকতে চায়।হুহ্! অতটা বোকা আমি না!আর কোনদিন আন নোউন নম্বর থেকে আসা কলই রিসিভ করবো না!
'
ফোন রেখে আমি খানিক সময় বিছানার উপর বসে রইলাম। পেটে একটু পর পর লাথি বসিয়ে দিচ্ছে আমার দুষ্ট বাবুটা! আমার কষ্ট হচ্ছে। তবুও এই কষ্টকে কষ্ট মনে হয় না কোন মায়ের!আমি আমার ডান হাতটা আমার পেটে আলতোভাবে বুলিয়ে দিয়ে বললাম,'লক্ষ্মী সোনা, তুমি পৃথিবীতে আসার জন্য পাগল হয়ে গেছো একেবারে! এখনও তো তোমার সময় হয়নি! এবার শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে থাকো।সময় হলে তোমায় পৃথিবীতে আনার আয়োজন করা হবে!'
এরপর আর বাবু মায়ের পেটে লাথি দেয়নি।সে সম্ভবত বোঝে গেছে মায়ের কষ্ট হচ্ছে। দুষ্টুমি করা ঠিক হচ্ছে না মায়ের সাথে!
আমি এসব ভাবছিলাম আর মিটিমিটি হাসছিলাম। ঠিক তখন আমার শাশুড়ি আমার পাশে এসে বসলেন। তার মুখ মলিন। তিনি আমার পাশে এসে বসে বললেন,'তৃষা, তোমার চেহারা এমন বিষণ্ণ দেখাচ্ছে কেন মা?'
আমি চমকে উঠে হাসার চেষ্টা করে বললাম,'কই না তো মা! টেনশন করবো কী নিয়ে আবার!'
আমার শাশুড়ির সন্দেহ যেন কিছুতেই কাটছে না। তিনি এবার বললেন,'তাহলে এভাবে মুখ আঁধার করে চুপচাপ বসে আছো কেন?'

আমি শাশুড়ি মাকে কী উত্তর করবো তা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।এক পর্যায়ে এসে একটু ঘুরিয়ে প্যাচিয়েই  বললাম। সামান্য হেসে বললাম,'মা, আজকাল আপনার নাতী এসে আমার পেটে লাথি গুঁতো দেয়। মাঝেমধ্যে কষ্ট হয় খুব।একটু আগেও এমন করেছে। ওকে নিয়েই ভাবছিলাম!'
শাশুড়ি মা এবার মিষ্টি করে হাসলেন। হেসে বললেন,'মা হওয়া কী অত সহজ?একটু লাথি গুঁতো খাবে না,কষ্ট অনুভব করবে না তবে তুমি কিসের মা! তবে টেনশন করার কিছু নাই। এইগুলো স্বাভাবিক। আমার শুভ যখন পেটে তখন সেও এমন ছটফট করতো।লাথি গুঁতো দিতো।একেক দিন আমার মনে হতো এই বুঝি পেটের চামড়া ছিঁড়ে ও বেরিয়ে আসবে! আমার শাশুড়ি তখন বলতেন,বউ, তোমার ছেলে বাচ্চা এক নম্বরের ত্যাদড় হবে দেইখো!

কিন্তু আমার শুভ ত্যাদড় হয়নি।ওর আর কী বয়েসটাই বা হয়েছে?সবে সাতাশ গড়িয়ে আটাশে পড়লো।দেখো,বাবা হারানোর শোক কাটিয়ে উঠে কীভাবে সবকিছু সামলে নিয়েছে ও। আমার তো মনে হচ্ছে শুভ তার স্কিল দিয়ে তার বাবাকেও হাড় মানিয়ে ছাড়বে!'
আমি শাশুড়ি মার মুখ থেকে নিজের স্বামীর উচ্চ প্রশংসা শোনে মিষ্টি করে হাসলাম। আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। নিজেকে বড় ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে।বাবা তবে ধনকুবেরের ছেলের কাছে বিয়ে দিয়ে কোন ভুল করেননি! যদিও মা বলেছিল, ওদের চরিত্র ভালো হয় না।অঢেল টাকা পয়সা থাকায় বকে যায় ওরা। ঘরে স্ত্রী রেখে ওরা বাইরে আট দশটা সুন্দরী দাসী পালে। ওদের সাথে মেলামেশা করে!
বাবা শোনে হেসে বলেছিলেন, আলতাফ হোসেন আমার বাল্য বন্ধু। তাকে আমি চিনি।তার ছেলেকেও আমি চিনি।তার স্ত্রীও মাটির মানুষ।যেহেতু শুভর মা চাচ্ছে মেয়েকে নিতে তবে আমাদের মতো গরীবের অত বাহানা করার কী প্রয়োজন?আমরা বরং হ্যা বলে দেই!

মা তখন আর না বলেননি। হয়তোবা তিনিও বুঝতে পেরেছিলেন এরচেয়ে ভালো সম্বন্ধ আমার জন্য আর আসতেই পারে না!
অতএব , শুভর সাথে বিয়ে হয়ে গেল আমার। বিয়ের আজ চার বছর পেরিয়ে গেছে। বিয়ের পর থেকে শুভ ভুলেও কোনদিন আমায় দুটো কটু কথা বলেনি। আমার শশুর যতদিন ছিলেন ততদিন নিজের মেয়ের মতো আমায় আদর সোহাগ করেছেন।আর শাশুড়ির কথা তো বলে শেষ করাই যাবে না! এমন একটা সংসারকে স্বর্গ বললেও যে কম হয়ে যাবে!
'
কিন্তু আমার পৃথীবিটা সম্পূর্ণ এলোমেলো হয়ে গেল আরো মাস দুয়েক পর। যেদিন শুভ এসে তার মায়ের কাছে আবদার করে বললো,সে একটা মেয়েকে দু বছর আগে গোপনে বিয়ে করেছে। সেই মেয়ের নাম অর্ণা।অর্ণাও নাকি কনসিভ করেছে। এবার সে চাপ দিচ্ছে তাকে ঘরে তোলার জন্য।তাই নাকি শুভ বাধ্য হয়েছে এসব প্রকাশ করতে!
আমার শাশুড়ি মা সব শোনে থতমত খেয়ে গেছেন। তিনি ছেলের সাথে একটি কথাও বলেননি। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
এরপর শুভ আমার কাছে এলো। এসে আমার একটা হাত ধরে মিনতির গলায় বললো,'তৃষা, বিশ্বাস করো আমার তখন কিছুই করার ছিল না!আমি বাধ্য হয়েছিলাম এটা করতে!'
আমার কষ্ট হচ্ছিল তখন। রাগে দুঃখে চোখ ভিজে উঠেছিল।নাকের নরম পাতা কাঁপছিল তিরতির করে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে আমি বললাম,'আপনি বাধ্য হয়েছিলেন মানে?ওর সাথে কী আপনার রিলেশন ছিল কোন রকমের?'
শুভ খাপছাড়া কিছু শব্দে এলোমেলো করে বললো,'না না তা না!'
'
তবে?'
'মেয়েটার বাবা আমার অফিসে জব করতো।'
'তো? আপনার অফিসে যে সকল পুরুষ জব করে তাদের সবার মেয়েকেই আপনি বিয়ে করবেন নাকি?'
শুভ ক্ষেপে উঠছে না আমার এমন উল্টাপাল্টা প্রশ্নে।সে বরং শান্ত গলায় বললো,'আমার কথা তো শুনো পুরোটা। নয়তো বুঝবে কী করে?'
আমি বললাম,'বলুন।শুনছি।'
শুভ এবার সব খুলে বলতে শুরু করলো।সে বললো,'অর্ণার বাবা ছাড়া আর কেউ নাই।ও বড় অসহায় মেয়ে।গত দু বছর আগে হুট করে একদিন স্ট্রোক করে অর্ণার বাবা মার যায়।মেয়েটা অসহায় হয়ে পড়ে।আমি তখন বাধ্য হই তাকে বিয়ে করতে!'
আমি এবার শব্দ করেই হেসে উঠি। হেসে বলি,'দারুণ তো নাটক টা।মানে আপনি বিয়ে করে দায়িত্ব পালন করলেন এই তো?'
শুভ এবার কিছু টা রাগলো যেন। রেগে গিয়ে বললো,'মজা নিচ্ছো কেন এটা নিয়ে? বিয়ে করেছি।কারোর সাথে অবৈধ ভাবে তো গাটছাট বাঁধিনি!'
আমি এবার বললাম,'তো এসব আমায় বলছেন কেন?'
'অনুমতি দেয়ার জন্য।'
'কিসের অনুমতি?'
'অর্ণাকে এ বাড়িতে আনতে চাই। তাছাড়া সেও আমার সন্তানের মা হতে চলেছে!'
'তো এতে আমার অনুমতির কী আসে যায়! বিয়ে করার সময় অনুমতি নেননি এখন অনুমতি নিয়ে কী করবেন? শুধু অর্ণাকে কেন?আরো একশোটা মেয়ে এনে ঘরে রাখেন। এতে আমার কী!'
শুভ আর কিছু বললো না। চুপচাপ এখান থেকে বেরিয়ে গেল।ও চলে যাওয়ার একটু পরই আমার পেটে চিনচিনে একটা সরু ব্যথা শুরু হলো। শীতের সন্ধ্যা। এই সন্ধ্যাতেও আমার কপাল ঘামছে।কষ্ট হচ্ছে খুব।আজ শাশুড়ি মাও আমার কাছে আসছেন না।তার মন অসম্ভব রকমের খারাপ।ছেলে যে কান্ড করেছে তা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি আমার স্বামী কী করেছে না করেছে এসব নিয়ে টেনশনও করতে পারছি না।ব্যথা আমায় কাবু করে ফেলছে। সেই ব্যথা আস্তে আস্তে বাড়ছে।এশার আজান যখন হলো তখন তা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করলো।এক পর্যায়ে সহ্য করতে না পেরে আমি গলা ছেড়েই কাঁদতে শুরু করলাম। আমার কান্না শোনে দৌড়ে আমার কাছে এলেন মা। এসে অস্থির হয়ে আমার হাত ধরে বললেন,'কী হয়েছে মা কী হয়েছে তোমার?'
আমি সবকিছু খুলে বললে মা আমাদের ড্রাইভারকে ফোন দিলেন।ড্রাইভার আসতে দেরি করলো না। হাসপাতালে যেতে আধ ঘন্টা সময় লেগেছে। এরপর শুভকেও খবর দেয়া হয়েছে।

শুভ এসেছে এবং আমায় সাহস দিয়েছে।যদিও তখন মা শুভর সাথে কথা বলেনি। শেষ রাতের দিকে কোন জটিলতা ছাড়াই আমার একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। সন্তান দেখে তার বাবা দাদি দুজনই খুশি। এমনকি শুভ আমার জন্য তড়িঘড়ি করে অর্ডার দিয়ে সোনার চেইন আনিয়েছে। সেই চেইন আমার গলায় পরিয়ে দিয়ে বলেছে,'আমায় এমন একটা রাজকন্যা উপহার দিয়ে তুমি আমায় ধন্য করেছো। এবার বলো আমার কাছে তুমি কী চাও?'
আমার সত্যিই কান্না পাচ্ছিলো তখন।কারণ আমি জানি শুভর মুখে এমন সুন্দর কথা মানায় না! আমি তাই ওর সাথে কোন কথাই বলিনি।

এরপর শুভ বাসায় চলে গেল। বাসায় কেউ নেই।কাজের লোকেরা আছে। এদের মধ্যে আবার দু একটার স্বভাব চরিত্র ভীষণ রকম খারাপ।ঘর খালি পেলে জিনিস পত্র সরিয়ে ফেলাতে এরা উস্তাদ।তাই আমার শাশুড়ি শুভর সাথে রাগ থাকা সত্ত্বেও বললেন,'তুমি বাসায় চলে যাও শুভ।বাসাটা একেবারে খালি পড়ে আছে।'
শুভ অবশ্য একবার বললো,'মা,যদি কোন কিছুর প্রয়োজন হয়?'

মা বললেন,'হলে তো ড্রাইভার ফখরুল আছেই। তোমার টেনশন করতে হবে না এ নিয়ে! তুমি পারলে কাল দিনে একবার এসো।'
কিন্তু পরদিন শুভ হসপিটালে এলো না। তার পরিবর্তে এলো আমাদের বাসার ম্যানেজার মোজাম্মেল চাচা। তিনি এসে মাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে কী যেন বললেন।মা তখন রেগে গেলেন এবং উত্তেজিত হয়ে বললেন,'কত বড় সাহস! আমার ঘরে ওই মেয়েকে নিয়ে ঢুকেছে!আমি এক্ষুনি বাসায় যাবো।ঘাড় ধরে ওদের দু'টোকেই বের করবো আজ!'
কথাগুলো বলে মা প্রস্তুতি নিতে লাগলেন  বাসায় চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কী দূর্ভাগ্য মা আর তখন যেতে পারলেন না! আমার একদিন বয়সী রাজকন্যাটা হঠাৎ কেমন করতে লাগলো। ওকে দেখে বোঝা যাচ্ছে খিঁচুনি হচ্ছে ওর। আমি গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করলাম।মাও এসে কাঁদতে শুরু করলেন। একজন নার্স তখন এগিয়ে এলো আমার রাজকন্যার কাছে। অদ্ভুত বিষয় হলো সেই নার্সের চোখও ভিজে উঠেছে জলে।আমি স্পষ্ট দেখলাম সেও কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে কোথায় যেন ফোন করলো সে!
'

ডাক্তার সাঈদ মুরসালিন এই হসপিটালের কোন দায়িত্বরত ডাক্তার নন। তিনি অবশ্য ময়মনসিংহ বিভাগের শিশু বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ডাক্তার। দায়িত্বরত নার্স তাকেই ফোন করেছিল। তিনি এসেছেন সঙ্গে সঙ্গে। এসে দেখেন আমরা কাঁদছি। আমার রাজকন্যা চোখ মুখ উলটে দিচ্ছে।ডাক্তার সাঈদের কাছে আমি অনুনয় বিনয় করে বললাম,'আল্লার দোহাই লাগে আপনি আমার মেয়েকে বাঁচান স্যার!'

ডাক্তার সাঈদ বললেন,'অস্থির হবেন না আপনি!আমি দেখছি।'

এরপর তিনি আমার মেয়ের গায়ে হাত দিলেন।নার্ভ চেক করলেন।ব্যাগ থেকে বের করে কী একটা ইনজেকশন দিলেন। ইনজেকশন দেয়ার মিনিট পাঁচেক পড়েই মেয়ে আমার ঘুমিয়ে পড়লো।

আমি তখনও ভয় পাচ্ছি।ভাবছি এটা কী কোন স্বাভাবিক ঘুম?

ডাক্তার সাঈদ আমায় অভয় দিলেন। বললেন,'আর কোন চিন্তা নাই।মেয়ে সুস্থ এখন।'

এরপর নার্সের সাথে কী বলে যেন ডাক্তার সাঈদ চলে গেলেন।আমি তখন নার্স আপুকে ধন্যবাদ দিলাম। ধন্যবাদ দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,'আচ্ছা আপু সাঈদ স্যার তো অনেক বিজি মানুষ।রোগী দেখেই কুলিয়ে উঠতে পারেন না।উনি আপনার একটা মাত্র ফোন কলেই চেম্বার থেকে সঙ্গে সঙ্গে যে এসে পড়লেন?উনি আপনার কে হোন?'

নার্স আপু হাসলেন। হেসে বললেন,'সাঈদ

আমার হাসব্যান্ড।'

আমি এই কথা শুনে ভীষণ রকম অবাক হয়েছি। অবাক হওয়ার কারণ হলো একজন নার্সকে উনি বিয়ে করেছেন?অথচ উনার যা নাম ডাক!যা অর্থ বিত্ত এবং সম্মান!তার জন্য কী আরেকটি ডাক্তার মেয়ের অভাব ছিল?

হতে পারে তিনি নার্স আপুকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। ভালোবাসা এমন-ই।ধনী গরীব রুপ গুণ দেখে হয় না।

আমি এক পর্যায়ে নার্স আপুকে বললাম,'আপু আপনি অনেক বড় ভাগ্যবতী!'

কথাটা শুনে হাসলেন না নার্স আপু। বরং চোখ থেকে দু ফোটা জল ফেলে দিলেন।আমি অবাক হলাম। আচ্ছা উনারও কী আমার মতো পারিবারিক কোন সমস্যা?

ভালোবেসে বিয়ে করেছেন কিন্তু এখন অসুখী?সাঈদ স্যার অন্য কোন নারীতে আসক্ত?

এখন তো কতোই এমন হয়!ভুরি ভুরি দেখেছি। আমার নিজের ঘরেই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ।শুভর চেয়ে ভালো ছেলে আমার জীবনে আমি দেখিনি। কিন্তু সে-ই গোপনে কত কী করে ফেললো!

আমাকে জিজ্ঞেস করতে হলো না এসব।নার্স আপুই নিজ থেকে বললেন। বললেন,'গত পাঁচ মাস আগে তার একটি ছেলে সন্তান মারা গেছে।তাও জন্মের এক সপ্তাহ পর। আমার মেয়ের মতো খিঁচুনিতেই।ডাক্তার সাঈদ ঢাকায় ছিলেন।একটা ট্রেনিংয়ে।আর এদিকে তার ছেলের শুরু হলো খিঁচুনি। তাড়াহুড়ো করে হসপিটালে নিয়ে এসেছিল ছেলেকে নার্স আপু। কিন্তু কাজ হয়নি। ইনজেকশন দেয়ার আগেই ছেলে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল ওপারে!'

আমি নার্স আপুকে সান্তনা দিলাম।আর বুঝতে পারলাম উনি বোঝেন সন্তানের মৃত্যু কতোটা ভয়াবহ!বোঝেন বলেই সঙ্গে সঙ্গে স্বামীকে ফোন করে আনিয়েছিলেন এখানে।স্বামীও সঙ্গে সঙ্গে এসেছেন।কারণ সেও যে সেই এখই দুঃখে দুঃখী!

সন্তান হারা!

'

মা বাসায় গিয়েছেন পরদিন।আমায় সাথে নেননি।আরো দু'দিন এখানে থাকতে হবে আমার। যদিও আমি চলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মা বলেছেন বাসার পরিস্থিতি বৈরী। আগে তিনি ওই মেয়েকে বাসা থেকে বের করবেন। তারপর আমার বাসায় যাওয়া। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো অর্ণাকে কিছুতেই বাসা থেকে বের করা গেলো না।ওর হাতে বিয়ের ডকুমেন্ট আছে। তাছাড়া তার পেছনে লোক বলও আছে।অর্ণা সরাসরিই বলেছে, তাকে এই বাড়ি থেকে তাড়াবার চেষ্টা করলে সে ভয়ংকর কিছু করবে। পুলিশ নিয়ে আসবে বাড়িতে। তাছাড়া তার পক্ষে অবস্থান করবে আমার শ্বশুরের রেখে যাওয়া ব্যবসায়ী প্রতিদ্বন্দ্বীরাও!মামলা টামলা করে একটা নাজুক অবস্থার সৃষ্টি করবে মেয়েটা।আর সবচেয়ে বড় কথা হলো ওই মেয়ের পেটে আবার শুভর সন্তান।এটাই বড় শক্তি তার।শুভও মেয়েকে এ বাড়িতেই রাখবে।মা অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যেতে লাগলো।শেষে তিনি চুপ হয়ে গেলেন। এবং হসপিটালে আমায় নিতে এসে বললেন,'মাগো, পরিস্থিতি ভালো না মোটেও।ক'দিন যাক। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আপাতত এ নিয়ে কিছু করা যাবে না। তোমাকে কদিন একটু সহ্য করতে হবে।'

আমি বললাম,'কেন মা?'

তিনি সবকিছু খুলে বললেন।

'শত্রুরা ওৎ পেতে আছে। সুযোগের অপেক্ষা করছে ওরা।আমি ওদেরকে সেই সুযোগ করে দিতে পারি না!'

আমার কষ্ট লাগছে খুব।আমি জানি এমন পরিস্থিতিতে বাসায় থাকা আমার জন্য কতোটা কষ্টের! তবুও বললাম,'মা চলুন।আমি পরিস্থিতি সামলে নেবার চেষ্টা করবো।'

মা আমায় অভয় দিলেন। বললেন,'ভয়ের কিছু নাই।আমি থাকতে তোমার হাতেই এ বাড়ির রাজত্ব। এছাড়া ওই অর্ণা না ফর্ণা তাকে আমি যে করেই হোক এ বাড়ি থেকে বের করবোই।'

আমি বললাম,'আচ্ছা।'

'

আমি ভেবেছিলাম অর্ণা বোধহয় এ বাড়িতে ভয়ে ভয়ে থাকবে। চুপচাপ থাকবে। কোনমতে এ বাড়ির আশ্রিতা হবে। কিন্তু আমার ভাবনা হলো উল্টো। বাসায় ফিরে দেখি আমার ঘরেই অর্ণা তার রাজশয্যা সাজিয়ে বসে আছে। এই ঘর এখন তার দখলে।আমি ঘরে ঢুকতে চাইতেই সে বাঁধা দিলো।বললো,'এই ঘরে না।অন্য ঘরে যাও।এ ঘর এখন থেকে আমার।'

ওর এমন স্পর্ধা দেখে আমি রাগে কাঁপতে শুরু করলাম।মাও আমার পাশে। কিন্তু তিনি চুপচাপ।

আমি ওকে বললাম,'থাপরিয়ে সবগুলো দাঁত ফেলে দিবো ফাজিল মেয়ে।উড়ে এসে জোড়ে বসেছে যেন!ভালোয় ভালোয় এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাও বলছি। নয়তো--'

আমার মুখ থেকে কথাটা টেনে নিলো অর্ণা। তারপর সে বললো,'নয়তো কী?কী নয়তো? আমার হাসব্যান্ডের ঘরে এসে আমায় হুমকি দেয়া হচ্ছে?'

মা তখন ধমক দিলেন অর্ণাকে। বললেন,'কিসের হাসব্যান্ড ? নষ্ট মেয়ে কোথাকার!

অত সাহস কে দিয়েছে তোমায় হ্যা?ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিবো এক্ষুনি!'

অর্ণা হাসলো। হেসে বললো,'এই বাড়ি কী আপনার? আপনার নামে লিখা?'

মা উঁচু গলায় বললেন,'এইটা তোমার জেনে কী লাভ এই বাড়ি কার নামে লিখা?'

অর্ণা আবার হাসলো। হেসে বললো,'আমার হাসব্যান্ডের নামে লিখা। সো, গলাটা একটু নামিয়ে কথা বলবেন। বুঝেছেন?'

মা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন এবং ওর গালে চড় বসিয়ে দিতে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু চড় দিতে পারলেন না। ঠিক তখন এসে ঘরে উপস্থিত হয়ে গেল শুভ। এবং মায়ের হাতটা খপ করে ধরে ফেললো সে।মা তাজ্জব বনে গেলেন একেবারে। কিছু বলতে যাবেন তিনি এর আগেই শুভ বলে উঠলো,'আমার স্ত্রীকে শাসন করার একমাত্র আমার একার অধিকার আছে।আর কারোর কোন অধিকার নাই!'

মা কেঁদে ফেললেন। কেঁদে কেঁদে তিনি বললেন,'এসব কী বলছিস শুভ তুই?'

শুভ বললো,'তোমরা যদি জল আরো ঘোলাটে করতে চাও তবে আমিও কিন্তু ভয়ংকর হবো মা।'

মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন,'তোকে না আমি জন্ম দিয়েছি।তুই এমন চরিত্রহীন হলে কী করে রে শুভ?'

শুভ বললো,'হ্যা দিয়েছো। কিন্তু আমি চরিত্রহীন নয়।'

'নষ্ট একটা মেয়ে নিয়ে ঘরে উঠেছিস তবুও বলছিস তুই চরিত্রহীন নয়?'

শুভকে কোনদিন রাগান্বিত অবস্থায় দেখিনি আমি।আমি ভাবতাম এই লোকটা একটা মাটির মানুষ। সহজ সরল।রাগ জিনিসটা তার রক্তে আদৌও নাই। কিন্তু আজ ভয়ংকর রাগ দেখাচ্ছে সে।মার দিকে চোখ লাল লাল করে তাকিয়ে বললো,'মা আরেকবার যদি অর্ণাকে নিয়ে তুমি কুরুচিপূর্ণ কোন কথা বলো তবে আমিও কিন্তু তোমার সাথে ভালো আচরণ করবো না বলে দিলাম!'

মা অবাক হলেন। এবং ঘাবড়ে গেলেন। তিনি অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললেন,'কী করবি তুই?আমার গায়ে হাত তুলবি?'

শুভ এরপর মাকে কী বললো তা শুনতে পাইনি আমি আর।কারণ ও ঘরে মেয়েকে শুইয়ে রেখে এসেছিলাম আমি। হঠাৎ এমন চিৎকার শুরু করলো মেয়ে! দৌড়ে গেলাম মেয়ের কাছে। ওকে যতোক্ষণে শান্ত করলাম ততক্ষনে দেখি মা আবার বোরকা পরেছেন।দু হাতে দুই ব্যাগ। আমার কাছে এসে ব্যাগ দুটি মাটিতে রেখে আমার কাছ থেকে আমার মেয়েকে কোলে নিলেন তার। তারপর আদর করে চুমু খেয়ে আবার আমার কোলে উঠিয়ে দিয়ে বললেন,'মা,কতো সময় কতো কথা বলে ফেলেছি তোমায়। আমার প্রতি কোন রাগ রেখো না!'

কথাগুলো বলতে গিয়ে তিনি চোখ মুছলেন।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,'এসব কী মা? আপনি কোথায় যাচ্ছেন?'

মা বললেন,'বাপের বাড়ি।বাপ তো নাই। ভাইয়ের ঘরে গিয়ে উঠি।'

বলে শব্দ করেই কেঁদে উঠলেন তিনি।

আমি নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না।মার সাথে কাঁদতে শুরু করলাম। কাঁদতে কাঁদতে বললাম,'মা, আপনি চলে যাচ্ছেন কেন? আপনি না বললেন এ বাড়ি থেকে ওদের তাড়িয়ে দিবেন?'

মা বললেন,'মেয়েদের হাতে যে অত বড় ক্ষমতা নাই গো মা! এই বাড়ি তো আর আমার নামে না। ছেলের নামে।আমি এতো দিন ভাবতাম আমার ছেলেই আমার সম্পদ। কিন্তু এখন দেখি সে-ই আমার না।চলে যেতে বলেছে আমায়। এখানে থাকলে নাকি আমার চুপচাপ থাকতে হবে।ওর বিরুদ্ধে টু শব্দও করা যাবে না।যদি এভাবে না থাকতে ইচ্ছে করে তবে নাকি আমার জন্য সব সময় দোয়ার খোলা আছে।চলে যেতে বলেছে আমায়!'

মা শব্দ করে কাঁদছেন। আবার ব্যাগ দুটো হাতে উঠিয়ে নিয়েছেন তিনি।

আমি বললাম,'আমিও যাবো মা। আমিও যাবো আপনার সাথে।'

তিনি বললেন,'না। আমার নিজেরই কোন ঠিক ঠিকানা নাই। ভাইয়ের বাড়িতে আমি নিজেই আশ্রিতা হয়ে থাকবো।কী জানি আমায় ওরা রাখে কি না!দিন পাল্টেছে এখন। নিজের ছেলেই ঘরে রাখে না।ভাই এখন বৃদ্ধ। ছেলেদের হাতেই সব দায়িত্ব।কী জানি ওরা আমায় রাখে কি না!

 যেখানে আমার নিজের পায়েই মাটি নেই সেখানে তোমায় সাথে করে নেই কী করে গো মা?তুমি থাকো। আল্লাহ তোমার প্রতি অবশ্যই সদয় হবেন।'

মা চলে গেলেন।মা চলে যাওয়ার সময় শুভ ঘরেই ছিলো।সে তখন টু শব্দটি পর্যন্ত করলো না। তাকিয়ে দেখলোও না পর্যন্ত

আমিই তখন চিৎকার করে বললাম।

'আল্লাহ গজব নাজিল করবেন। আল্লাহ অত সহজে ছেড়ে দিবেন না এই পাপের জন্য!'

আমার কথা শুনে শুভ আর অর্ণা উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করে দিলো।তারা যেন খুব মজা পাচ্ছে এতে!

আর আমি তখন রাগে------


আর আমি তখন রাগে শুভকে বললাম,'তুমি বুঝতে পারছো না ঠিক কার পাল্লায় যে পড়েছো!ও মানুষ না শয়তান একটা।তোমায় ধ্বংস করে ছাড়বে দেইখো ও! সবকিছু ও শেষ করে দিবে।ও একটা ছলনাময়ী।ও ভালোর জন্য এই বাড়িতে ঢুকেনি শুভ!'

অর্ণা তখন গাল ফুলিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে সে শুভকে বললো,'দেখেছো আমাকে নিয়ে কত বাজে বাজে কথা বলছে ও! তুমি কী ওকে এর জন্য কোন পানিশমেন্ট দিবা না শুভ? তুমি যদি কোন পানিশমেন্ট না দেও তবে আমি বুঝবো ওর জন্যই তোমার সব দরদ। আমার জন্য তোমার কোন দয়া মায়া ভালোবাসা নাই।আমায় তুমি তোমার ঘরের দাসি বাদীই মনে করো!'

শুভ হঠাৎ চোখ গরম করে আমার দিকে এগিয়ে এলো তখন।অর্ণাকে সে ভীষণ রকম ভালোবাসে,অর্ণার প্রতি তার ভীষণ মায়া এটা দেখাতে গিয়ে আমার গালে শক্ত দুটো চড় বসিয়ে দিলো। তারপর ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বললো,'এ বাড়িতে থাকতে হলে চুপচাপ থাকতে হবে।কথা বললেই আউট করে দিবো। এটাই আমার লাস্ট ওয়ার্নিং।'

আমি তখন আর দশটা মেয়ের মতো চুপ করে থাকলাম না। যদিও আমার তখন খারাপ লাগছে। এমনিতেও শরীর দূর্বল!

তবুও আমি ওর দিকে গলা বড় করে বললাম,'আমায় মেরে ফেললেও আমি চুপ করে থাকবো না। এই মেয়ে তোমার সব শেষ করে ছাড়তে এসেছে। কিন্তু আমি তা হতে দিবো না। আমার সোনার সংসার এভাবে আমি শেষ হয়ে যেতে দিবো না।'

অর্ণার কান্না তখন আরো বাড়লো।

আর শুভ তখন আমার সামনে এসে ধমক দিয়ে বললো,'ফকিরনির মেয়ে কোথাকার! তোর সোনার সংসার?তোর বাপের টাকায় করেছি এসব নাকি রে?তোর বাবাই তো আমার বাবার উপর নির্ভর করে থাকতো। কদিন পর পরেই হাত পেতে ভিক্ষে নিতো!আসলে তোরে বিয়ে করাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। তুই যদি আরেকবার অর্ণাকে নিয়ে কোন কথা বলিস তবে আমি তোর জন্য ভয়ংকর রুপ ধারণ করবো কিন্তু! এই বলে দিলাম শেষবার।'

আমার ভীষণ খারাপ লাগছে বাবাকে নিয়ে এসব বলায়।আমি জানি আমার বাবা মোটেও এরকম মানুষ ছিলেন না। কারোর কাছ থেকে হাত পেতে এক পয়সা নেয়ার মানুষ না। শেষ বয়সেও গ্রামের ছেলে মেয়েদের প্রাইভেট টিউশনি করিয়ে অল্পবিস্তর যা কিছু পেয়েছেন তা দিয়েই পরিবারের খরচ চালিয়েছেন।তাই এটা মেনে নিতে না পেরে আমি বললাম,'এই মেয়ের জন্য আমার বাবার নামে এসব মিথ্যে মিথ্যে অপবাদ দিলে তুমি! ছিঃ! ওই মেয়ে যে একটা ডাইনি তা তুমি এখনও বুঝতে পারোনি। কিন্তু খুব দ্রুত সব টের পাবে তুমি। কিন্তু ততক্ষণে তোমার সবকিছু শেষ করে ছাড়বে ও!'

এরপর শুভ আমার দিকে অনেকক্ষণ ধরে চোখ গরম করে তাকিয়ে থেকে দাঁত কটমট করতে লাগলো। তারপর কী ভেবে যেন রাগে আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার গলা থেকে এক টানে এক সপ্তাহ আগে ওর দেয়া চেনটা খুলে নিয়ে ঘরের ভেতর চলে গেল।আমি ওখানেই অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থেকে চোখের জল ফেললাম। তারপর ঘরে এসে মেয়েকে কোলে টেনে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে কাঁদতে শুরু করলাম।

মেয়ে তখন কী বোঝেছে কে জানে!আমি যখন কাঁদছি সে তখন একেবারেই নিশ্চুপ। শুধু চোখ বড় বড় করে বড়দের মতো করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছে।

'

সেদিন সন্ধ্যা বেলায় হুট করে আমাদের বাসার বুয়া নাসরিন আমার কাছে এসে বললো,'আফা,আফনের কী কী ব্যাগ পত্তর গোছায়বেন সব গোছায় ফেলেন।অর্ণা আফা বলছে আফনের কোন জিনিস এই বাড়িতে রাখা যাইবো না!'

আমি ওর কথা বুঝতে পারছি না।তাই ওকে এক প্রকার ধমক দিয়েই বললাম,'কী বলো ক্লিয়ার করে বলা যায় না?আমি বুঝতে পারিনি তুমি কী বলছো। এখন স্পষ্ট করে বলো।'

নাসরিন কিছু বলার আগেই আমার ঘরে অর্ণা চলে এলো। এবং এসে একটা চেয়ার টেনে বসে বললো,'তোরে আজকে ডিভোর্স দেয়া হবে।আর আগামীকাল ভোরবেলা ড্রাইভার তোরে তোর বাপের বাড়িতে রেখে আসবে গিয়ে। এখন ক্লিয়ার হয়েছে তো বিষয়টা?'

আমি অর্ণার এই কথাগুলো হজম করতে পারিনি।তাই রেগেমেগে আগুন হয়ে অর্ণার কাছে এসে অর্ণার গালে একটা চড় বসিয়ে দিলাম।শুভ তখন বাসায় ছিল না।অর্ণা চড় খেয়ে তখন পাগলের মতো শুভকে ফোন দিয়ে কেঁদে কেঁদে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,'তোমার বাসার চাকরানীটা আমায় মেরেছে।আরেকটু হলে মেরেই ফেলতো একেবারে। তুমি এক্ষুনি বাসায় আসো।না জানি কখন আবার আমায় মেরে টেরে ফেলে।একা একা আমার ভীষণ ভয় করছে!'

তারপর ফোন রেখে দিলো অর্ণা।

আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,'এসব কী বানিয়ে বানিয়ে বলছো তুমি ওর কাছে?ডাইনি মেয়ে একটা!'

অর্ণা হাসলো। হেসে বললো,'অপেক্ষা করো। তোমার দিন আজকেই শেষ।'

'

শুভর ফিরতে খুব একটা দেরি হলো না! 

সে ফিরতেই ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো অর্ণা। তারপর কাঁদতে শুরু করলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,'আমি এখানে থাকতে পারবো না শুভ।ও মেরে ফেলবে আমায়!'

ওর সঙ্গে তখন গলা মিলিয়ে বাসার বুয়া নাসরিনও ঠিক একই কথাই বললো।

সে ইনিয়ে বিনিয়ে বললো,'ছার,তৃষা আফা অর্ণা আফারে আরেকটু হইলে মাইরেই ফেলতো! ভাগ্য ভালো আমি ফিরাইতে পারছিলাম!'

শুভ থম মেরে খানিক সময় দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আমায় উদ্দেশ্য করে বললো,'তোর জন্য কাগজ পত্র রেডি হচ্ছে।দু একদিনের ভেতর ডিভোর্স পেপার পেয়ে যাবি। তখন সাইন করে দিস ওটায়।আর এখন তুই আমার বাড়ি ছাড়বি। তোর জন্য এই বাড়ির দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ।ড্রাইভার ফখরুল এখন তোকে দিয়ে আসবে তোর বাবার বাড়িতে গিয়ে।'

আমি শুভর কথাগুলো শুনে  সত্যিই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। এবং শুভকে বললাম,'এসব কী বলছো তুমি শুভ? পাগল হয়ে গেছো নাকি?'

আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম।ওর সামনে।ওর একটা হাত ধরতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ও ঝাঁকুনি দিয়ে হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,'তোমার সাথে আমার সকল সম্পর্কের অবসান হলো এখানেই। আমার মেয়েকে তুমি লালন পালন করে বড় করে দিবে। বিনিময়ে তার সব খরচ সহ তোমায় মান্থলি একটা স্যালারি দিবো আমি!'

আমি কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। এমন সময় কী বলা যায়?

শুধু রাগে দুঃখে এটুকু বললাম,'আমার মেয়েকে তোমার মতো পাপী কোন পিতার একটা পয়সা খাইয়েও বড় করবো না আমি। এই মেয়ে কোনদিন তোমার নাম পর্যন্ত জানবে না!ও জানবে ওর শুধুমাত্র মা আছে।বাবা নাই!'

শুভ কথা বললো না।তার মেয়েকে নিয়ে কোন রকমের আক্ষেপ নেই।সে অর্ণার মোহে অন্ধ। অন্ধ হয়ে গেছে বলেই কী করছে না করছে কিছু বুঝতে পারছে না।

শেষমেষ আমাকে সে রাতেই ও বাড়ি ছাড়তে হলো।গাড়ি করে ফখরুল এসে দিয়ে গেল আমার বাবার বাড়িতে। এখন অবশ্য এটাকে বাবার বাড়ি বললে ভুল হবে।যেহেতু বাবা মারা গিয়েছেন ছ'মাস আগে।মা আছেন। তিনি কোনমতে জীবন পাড় করছেন কষ্ট ক্লেশে।তার সাথে আমার এক মামাতো ভাই থাকে।নাহিন।আট বছর বয়স ওর।মামী মারা গেছেন ক্যান্সারে। এরপর থেকেই মামা পাগল। পাগল হয়ে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেলেন। এরপর থেকেই নাহিন আমাদের বাড়িতে।

হুট করে এতো রাতে এভাবে আমায় বাড়িতে আসতে দেখে মা চমকে গেলেন। অবাক হয়ে আমায় বললেন,'কী রে অত রাতে যে?তাও এই কাঁচা শরীর নিয়ে!'

আমি সঙ্গে সঙ্গে মাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম।

মা বললেন,'কী হয়েছে রে মা?কী হয়েছে তোর?'

আমি কাঁদতে কাঁদতেই বললাম,'সবকিছু শেষ হয়ে গেছে মা। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।'

তারপর সবকিছু খুলে বললাম।

মা শোনে তিনিও কাঁদতে লাগলেন। কিন্তু কী করবেন তিনিও বুঝতে পারছেন না। আমার মা আর দশজন মায়ের মতো নন। তিনি শক্ত পোক্ত ধরণের মহিলা।বিপদ থাকে সহজে টলে দিতে পারে না। তিনি আমায় সান্তনা দিয়ে বললেন,'ভাগ্যে যা লিখা আছে তাই হবে মা। ওখানে না থেকে ভালো হয়ছে। চরিত্রহীন মানুষের সাথে থাকার চেয়ে একা একা সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা অনেক ভালো!'

আমি কাঁদতে কাঁদতে মার আঁচলে মুখ লুকোলাম।আর আমার আঁচলে মুখ লুকোলো আমার মেয়ে। সেইদিন থেকেই আমাদের সংগ্রাম শুরু হলো। আমাদের মা মেয়ের। আমার মায়ের আমার আর আমার মেয়ের।

অনন্য শফিক


Post a Comment

কমেন্টে স্প্যাম লিংক দেওয়া থেকে বিরত থাকুন

Previous Post Next Post