![]() |
বাসর রাতের গল্প - নিস্পাপ ভ্রুণের আকুতি - bashor rater golpo Bengali |
বাসর রাতে রাতুল একটা আবদার করেছিল আমার কাছে। বলেছিলো,'মীম, আমরা বিয়ের পর প্রথম তিন বছর কোন বেবি নিবো না। ঠিক আছে?'আমি একটু হোঁচট খেলাম ওর কথাটা শুনে। হোঁচট খাওয়ার কারণ হলো আমার অনেক আগে থেকেই ইচ্ছে ছিল বিয়ের পর পরই আমি বাচ্চা নিবো।
আমার বয়স কম থাকতেই বাচ্চা বড় হয়ে যাবে। জীবন তো এমনিতেই ছোট। এই ছোট্ট জীবনটা বাচ্চা কাচ্চাদের নিয়ে উপভোগ করে কাটাবো। এই ইচ্ছে থাকাটাও দোষের না।তাই রাতুলের কথা শুনে আমার হোঁচট খাওয়া।রাতুলকে আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম,'রাতুল, আমার খুব ইচ্ছে বিয়ের পর পরই আমরা বাচ্চার বাবা-মা হবো।'
রাতুল হেসেই উড়িয়ে দিলো আমার কথাটা। তারপর বললো,'তিন বছর পর শখ পূরণ করো।'
স্বামীর ইচ্ছে।তাই এতে আর কোন কথা বললাম না। তিন বছর তো আর খুব বেশি সময় নয়।
কিন্তু বিয়ের পর বছর গড়াতে না গড়াতেই ভুলে আমি কন্সিভ করে ফেলি।যেদিন বুঝতে পারি আমি কন্সিভ করেছি সেদিন ভয়ে মিলিয়ে যেতে থাকি আমি।রাতুলকে কীভাবে বলবো এই কথা?
প্রথম কদিন বলবো বলবো করেও সাহসের অভাবে বলতে পারিনি। ভেবেছি বললে যদি রাতুল আমার সাথে খারাপ আচরণ করে? যদি বলে বেবি নষ্ট করে দাও। তখন আমি কী করবো? কী উপায় হবে আমার? আমি কী করে অনাগত একটা বাচ্চার খুনি হবো? তাও মা হয়ে!
কিন্তু না বললে পরে এটা নিয়ে আরো বড় ধরনের সমস্যা হয়ে যাবে এই ভয়ে আমি এক রাতে রাতুলের পাশে শুয়ে তার একটা হাত ধরে বললাম,'রাতুল, তোমার কাছে আজ একটা কথা বলবো। কথা না ঠিক বলতে পারো একটা সংবাদ শুনাবো তোমায়। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে,এটা শোনে যদি তুমি খুব রেগে যাও আমার প্রতি? যদি ভুল বুঝো? যদি ভুল কিছু করতে বলো আমায়?'
রাতুল আমার আরো কাছে তার মুখটা এনে মিষ্টি করে হাসলো। তারপর বললো,'নির্ভয়ে বলো।আমি তোমার হাসবেন্ড। হাসবেন্ডের কাছে কোন কথা বললে আবার ভয় পেতে হয়?'
আমি তবুও ভয়ে ভয়ে বললাম,'তুমি আমায় কথা দেও রাতুল, আমার কাছ থেকে সংবাদটা শোনে আমায় ভুল বুঝবে না তুমি?' রাতুল আমার হাতটা তার দু হাতে শক্ত করে ধরে বললো,'আমি তোমায় ভুল বুঝবো না। এবার তোমার সংবাদটা আমায় শুনাও তো! আমি এটা শুনার জন্য একেবারেই অধৈর্য হয়ে উঠছি!'
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,'রাতুল,আমি ভুলে কন্সিভ করে ফেলেছি।গত সপ্তাহে টের পেয়েছি এটা।'
রাতুল চমকে উঠলো খানিকটা। চমকে উঠে বললো,'কী বললে তুমি মীম?' আমি ভুলে কন্সিভ করে ফেলেছি।'
বলে আমি একেবারে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম।কান্না করার কারণ হলো আমার খুব ভয় করছিলো। কেন জানি মনে হচ্ছিল রাতুল এর জন্য আমায় অনেক কথা শোনাবে। বাচ্চাটাকে নষ্ট করে ফেলতে বলবে।তাই কাঁদতে লাগলাম।যেন ওর একটু হলেও মায়া হয় আমার প্রতি। বাচ্চাটাকে যেন আমি রক্ষা করতে পারি এবারের মতো।
কিন্তু রাতুল আমার কান্নায় মোটেও বিগলিত হলো না।সে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠে বললো,'তুমি এটা ইচ্ছে করেই করেছো মীম! তুমি তিন বছর ওয়েট করতে পারবে না তবে বাসর রাতে মেনে নিয়েছিলে কেন আমার দেয়া শর্ত? এখন তোমার ভুল তোমাকেই শুধরাতে হবে।বেবি নষ্ট করো।আমি তোমায় নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো। আগামীকাল সকালেই।'
আমি কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। পেটের ভেতর যে নতুন ভ্রুণের অস্তিত্ব তার বিনাশ আমি কী করে করবো? অত বড় পাষাণ আমি কী করে হবো? আমি কাঁদছি। খুব করে কাঁদছি।কান্না ছাড়া কিছুই আর করার নেই আমার। এমনিতেই আমি কিছুটা ভীতু স্বভাবের। ছোট বেলা থেকেই এমন।কারোর কথার পিঠে কথা বলতে পারি না।
রাতুল আরো রাগ দেখিয়ে বললো,'এসব ন্যাকামো করে লাভ নেই। সকাল বেলা তোমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো।'
আমি এবার নিরুপায় হয়ে ওর হাত ধরে বললাম,'আমি এটা করতে পারবো না রাতুল! আমার নিজের সন্তান। এই সন্তান তো তোমারও রাতুল। তুমি কী করে তোমার নিজের সন্তানকে খুন করে ফেলতে চাও?'
রাতুল আমার কথার কোন জবাব দিলো না।
সে রাতেই কাঁদতে কাঁদতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমাবার পর হুট করে স্বপ্ন দেখি ।দেখি একটা ফুটফুটে কন্যা শিশু যার পরণে লাল ফ্রক।যাকে স্বর্গীয় শিশুদের মতো দেখাচ্ছে।কী সুন্দর তার মুখ।সে এসে আমার শাড়ির আঁচল টেনে ধরে বলছে,'মা,মাগো,আমায় তুমি মেরে ফেলো না প্লিজ! আমাকে মেরে ফেললে আমি খুব কষ্ট পাবো মা! মা, আমাকে মেরে ফেললে তুমি হবে নিষ্ঠুর মা।যে নিজে তার সন্তানের খুনি।বলো তুমি, কোন মা কী তার সন্তানকে হত্যা করতে পারে?'
ঘুম ভাঙলো আমার কাঁদতে কাঁদতে। কিন্তু রাতুলের এতে যেন কিছুই আসে যায় না।সে একবার আমায় জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না আমি কেন কাঁদছি এভাবে?
সকাল বেলা রাতুল আমায় বললো,'রেডি হও।ডাক্তারের কাছে যাবো।' আমি বললাম,'আমি কিছুতেই যাবো না।মরে গেলেও না।' আমার এই কথা শুনে সে এমন ধমক দিলো! আমি ভয়ে আর কিছু বললাম না। কোন উপায় না পেয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম।
ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার কিছু টেস্ট নিলেন। রিপোর্ট আসার পর তা দেখে তিনি বললেন,'সব ঠিক আছে।ভ্রুণও ভালো আছে। পরিশ্রম করবেন কম।রেস্টে থাকবেন।সাস্থ্য সম্মত খাবার খাবেন।মনে রাখবেন, আপনার খাবারেই আপনার ভ্রুণ বলিষ্ঠ হবে। আপনি সুস্থ থাকলেই আপনার সন্তান সুস্থ এবং সুন্দর থাকবে।'
আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।তাই ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম,'বাচ্চা কী বড় করে নষ্ট করবেন তবে? আমি দিবো না নষ্ট করতে! কিছুতেই দিবো না!' ডাক্তার অবাক হয়ে বললেন,'কী বলছেন আপনি এসব? বাচ্চা নষ্ট করবো মানে?' আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।মাথা কেমন জানি করছে।মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাবো। এরিমধ্যে চেম্বারে ঢুকলো রাতুল।সে আমার একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল চেম্বারের বাইরে। তারপর দেয়ালের সাথে আমায় ঠেকিয়ে ধরে বললো,'কংগ্রেচ্যুলেশন।'
আমি এখনও কিছু বুঝতে পারছি না। রাতুল এসব কী করছে!
সে এবার মৃদু হেসে বললো,'রাতভর তুমি ঘুমিয়েছো।আর আমি জেগে জেগে ভেবেছি।আমি সব সময় ভাবতাম, বাচ্চা কাচ্চা হলে স্ত্রী বুড়িয়ে যাবে।তার প্রতি আমার শরীরের টান কমে যাবে। এই জন্য আমি বলেছিলাম কমপক্ষে বিয়ের পর তিন বছর তুমি বাচ্চা কাচ্চা নিবে না। কিন্তু গতরাতে যখন তুমি আমায় সংবাদটা শুনালে তখন হয়তো বা রাগে তোমায় আমি অনেক কিছুই বলে ফেলেছি। কিন্তু এরপর থেকেই আমার কেবল মনে হতে লাগলো, আমি ভুল করছি।কেউ কেউ সারা জীবন সাধনা করেও একটা সন্তান জন্ম দিতে পারে না।
কতো নিঃস্বন্তান মানুষের আহাজারি,কান্না আমি শুনেছি!আর আমি কি না স্ত্রীর গর্ভে আসা নিজের সন্তানকেই নষ্ট করে দিতে চাচ্ছি। এই কাজ করার পরিণাম কী ভয়াবহ হবে না? এই নির্মম কাজের জন্য যদি আল্লাহ রাগান্বিত হয়ে এরপর আর কখনো আমায় সন্তান না দেন তখন কেমন হবে? শরীর সে তো সাধারণ একটা বিষয়। মানুষ বুড়িয়ে যাবে, একদিন শরীরের আকর্ষন কমে যাবে এটা খুব সাধারন একটা বিষয়। এবং এটাই নিয়ম। এই জন্য তো আর নিজের সন্তানের আগমন ঠেকানো যায় না!
একজন পিতার কাছে তার সন্তান পৃথিবীতে আগমন করতে যাচ্ছে এরকম একটি সংবাদের কাছে বাকী সব লোভ তুচ্ছ হয়ে যায়। আমারও এরকম হয়েছে।আমি ডাক্তারের কাছে তোমায় নিয়ে এসেছি সন্তান নষ্ট করতে নয়, বরং আমাদের সন্তান কীভাবে সুস্থ সুন্দর ভাবে বেড়ে উঠবে সেই পরামর্শ নিতে।'
এরকম একটা আশ্বাস পাওয়ার পর কেউ কী না কেঁদে পারে? পারে না। আমিও কাঁদতে লাগলাম।রাতুলকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,'বাচ্চাটা নষ্ট করে ফেললে আমি পাগল হয়ে যেতাম রাতুল।'
রাতুল হেসে বললো,'সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলাম বলে নিজেকে ধন্যবাদ জানাই। নয়তো সারা জীবন একটা পাগল নিয়ে সংসার করতে হতো।'
আমি হাসলাম না। হাসতে পারলাম না।কারণ আমি এখনও একটা ধাঁধার জগতে আছি।ভাবছি, মানুষ কী করে নিজের অনাগত সন্তানদের হত্যা করে? ওদের কী একটুও কষ্ট হয় না?
লেখা - অনন্য শফিক
Post a Comment
কমেন্টে স্প্যাম লিংক দেওয়া থেকে বিরত থাকুন