![]() |
গল্প রাত যায় দিন যায় ১ থেকে ৪র্থ পর্ব অনন্য শফিক |
রাত যায় দিন যায় ১ম পর্ব অনন্য শফিক
অফিসে বসে আছি। আগামী সপ্তাহে অফিস বন্ধ হয়ে যাবে। এই জন্য প্রচুর কাজ জমেছে। আমার স্ত্রী জয়া তিনবার ফোন করেছে এই নিয়ে। আমাকে নিয়ে শপিংয়ে যাবে।আজ সকাল সকাল বাসায় ফিরতে বললো।
আমি বললাম,'ঈদের তিনদিন আগে যাবো। এখন অবসর নাই। বস ছুটি দিবে না!'
জয়া রাগ দেখিয়ে বললো,' বসের কাছে গিয়ে ফোন ধরিয়ে দেও।আমি একটু কথা বলবো।'
আমি বললাম,' কি বলবে?'
জয়া বললো,' বলবো,এক থাপ্পরে বসগিরি জীবনের জন্য ছুটিয়ে ফেলবো বেয়াদব! আমার হাসব্যান্ডকে এক্ষুনি ছুটি দে।ওর সঙ্গে আজ আমি শপিংয়ে যাবো।'
আমি হাসলাম। তারপর বললাম,' বসের ভাগ্য ভালো। সে এখন অফিসে নাই। থাকলে তো আমি ওর কাছে ফোন নিয়ে যেতাম। তখন তোমার এই বকাটা শুনতো,আর আমার জবটাও যেতো!'
জয়া বললো,' রাখি। তুমি তোমার জব নিয়ে পড়ে থাকো।জবের সাথেই ঘর সংসার করো।'
বলে ফোন রেখে দিলো।
আমিও কাজে লেগে গেলাম। টেবিল ভর্তি ফাইল।হিসেব মিলাতে মিলাতে মাথা খারাপের জোগাড়। সারাদিন রোজা রেখে এসব করতে আর ভালো লাগে না!
আমার মেয়ের নাম ঝিঁঝি।রাতে যে পোকা ডাকে সেই পোকার নামে নাম। তার মা রেখেছে।ঝিঁঝির বয়স দুই। বাসায় ফিরলে সেও বলে, বাবা শপিংয়ে যাবা না? চলো যাই।
সারাদিন অফিস করে রাত আটটায় বাসায় ফেরার পর শপিংয়ে যাওয়ার মতো শক্তি সামর্থ্য থাকে না।যাওয়া যায় না।চোখ জুড়ে তখন ঘুম নামে।দু' নলা খেয়ে ঘুমাতে হয়। অপেক্ষা করি ঈদের ছুটির।ছুটি হলে গিয়ে শপিং করবো।
অফিস শেষ করে বাসায় ফিরবো বলে রিক্সা নিলাম।রিক্সা করে যেতে আমার ভালো লাগে। নিরাপদ বাহন। রিক্সায় বসে আছি।রিক্সা চলছে। এরিমধ্যে ফোন বাজলো।পকেট থেকে ফোন বের করে দেখি আমার ভগ্নিপতি আসিফ কল করেছে।কল রিসিভ করতেই আসিফ বললো,' ভাইয়া, আপনার বোনকে নিয়ে আমি হাসপাতালে আছি। তার অবস্থা ভালো না!'
আমি আঁতকে উঠলাম। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,' কি হয়েছে আসিফ? তনুর কি হয়েছে?'
আসিফ বললো,' বি*ষ খেয়েছে।আমি দোকানে ছিলাম।বড় ভাবী হঠাৎ ফোন করে বললো,তনু বি*ষ খেয়েছে।আমি সঙ্গে সঙ্গে বাসায় এলাম। এসে দেখি বমি করছে। চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেছে। নেতিয়ে পড়েছে শরীর। তাড়াহুড়ো করে গাড়ি ডেকে ওকে নিয়ে এসেছি নিউ লাইফ হসপিটালে।'
আসিফ আর কিছু না বলেই ফোন কেটে দিলো। কেটে দেয়াই স্বাভাবিক ফোন।ও নিতুর স্বামী। তার স্ত্রীর জীবন মরণ অবস্থা। এমন সময় কারোর সঙ্গে ফোনে লম্বা কথা বলার মতো তার অবস্থা আছে নাকি?
আমার শরীর আজ এমনিতেই ক্লান্ত। সারাদিন রোদ দিয়েছে খুব। সন্ধ্যায় যে ইফতার দিয়েছে, ইফতার খেতে পারিনি। পেটে গ্যাস হয়েছে খুব।পানি খেয়েছি শুধু।একটা খেজুর খেয়েছিলাম। আগে ক্ষুধা ছিল না। এখন অনুভব করছি,খুব ক্ষুধা পেয়েছে। ইচ্ছে করছে ভাত খেতে। কিন্তু নিজের একমাত্র ছোট বোনের জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসব আজগুবি চিন্তা কেন মাথায় আসবে?
রিক্সা করে নিউ লাইফ হসপিটালে গেলে তিন ঘণ্টা সময় লাগবে। তিন ঘন্টার ভেতর অনেক কিছুই হয়ে যেতে পারে।আমি নিতুর ভাই। ওখানে কিভাবে, কিরকম চিকিৎসা হচ্ছে কে জানে! মা যখন মারা গেলেন তখন নিতু ক্লাস নাইনে পড়ে। মা নিতুকে আমার হাতেই সঁপে দিয়ে গেলেন। মৃত্যুর আগে আমার হাত ধরে বলেছিলেন, 'আগে তুই নিতুর ভাই ছিলি। এখন তুই নিতুর বাবা।মা। অভিভাবক।তুই ভুলেও কখনো নিতুকে কষ্ট দিস না! নিতুকে কষ্ট দিলে আমি কষ্ট পাবো।মনে রাখিস বাবা!'
আমি তাড়াহুড়ো করে রিক্সা থেকে নামলাম।ভাড়া দিলাম। তারপর একটা সিএনজিতে চেপে বসলাম।
সিএনজি ওয়ালা বললো,' ভাইসাব,দেরি হইবো কিন্তুক গাড়ি ছাড়তে। পাঁচজন না হইলে গাড়ি ছাড়ন যাইবো না।'
আমি বললাম,' পাঁচজনের যতো ভাড়া আসে এর সবটুকুই আমি দিবো। আপনি গাড়ি স্টার্ট করেন।দ্রুত যাবেন।'
সিএনজি ওয়ালার হাতে সিগারেট ছিল। সে সিগারেটের অর্ধেক শেষ করেছে।বাকি অর্ধেক শেষ না করে মনে হচ্ছে গাড়ি ছাড়বে না।
আমি ওকে তাড়া করলাম। বললাম,' আপনি কি কিছু বুঝতে পারছেন না নাকি? আমার ইমার্জেন্সি!'
সিএনজি ওয়ালা হাতে সিগারেট নিয়েই তার সিটে বসলো।গাড়ি স্টার্ট করলো।বললো,' কেউ মারা গেছে নাকি ভাইসাব?'
আমি কথা বললাম না।চুপ করে রইলাম।
সিএনজি চলছে।জোরেই চলছে।
এরিমধ্যে আবার ফোন এলো।জয়া ফোন করেছে। সে বললো,' তুমি কোথায় এখন? '
আমি বললাম,' গাড়িতে।'
সে বললো,' নিতু নাকি বি*ষ খেয়েছে? শুনেছো কিছু?'
আমি বললাম,' আমি ওখানে যাচ্ছি। তুমি টেনশন করো না।'
বলে ফোন রেখে দিলাম।জয়া টেনশন করবে কি না জানি না! নিতুকে ও তেমন সহ্য করতে পারে না।আমি প্রায়ই নিতুকে এটা ওটা কিনে দেই। ওর বিয়ের পাঁচ বছর হয়েছে। বাচ্চা কাচ্চা হচ্ছে না। এই জন্য ওর খুব মন খারাপ থাকে।আমি ওকে নিয়ে মাঝেমধ্যে ঘুরতে যাই। এসবের কিছুই পছন্দ না জয়ার। নিতু আমাদের বাসায় এলেও কেমন যেন মুখ শুকনো করে রাখে জয়া।নিতু মিশতে চায়।জয়া মিশে না।
নিতু ঝিঁঝিকে কোলে নিলে,আদর করলে মেয়েকে ডাক শুরু করে।ওর কাছে মেয়ে থাকুক তা পছন্দ করে না।
আমি অনেক বার জয়াকে বুঝিয়ে বলেছি।বলেছি, নিতু বড় দুঃখি মেয়ে।ক্লাস ফাইভে বাবাকে হারিয়েছে। নাইনের শুরুতে মাকে হারিয়েছে।একটা বাচ্চা কাচ্চাও নাই ওর।ওর আছে বলতে আমি আছি। ঝিঁঝি আছে। তুমি আছো।আর কেউ তো নাই ওর।'
আমার এসব কথা জয়া কানে তুলে না সম্ভবত। তাকে দেখি তখন ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে।
'
সিএনজি ছুটছে। আমার মনে হচ্ছে, ইশ্ আরো যদি দ্রুত যেতো! চোখের পলকে চলে যেতো!
আসিফকে কল দিলাম আমি।দু বার কল দেয়ার পর সে রিসিভ করলো।বললো,' আপনি কী আসতেছেন ভাইয়া?'
আমি বললাম,' হ্যা আসতেছি।আর আধঘন্টা লাগবে।আমি গাড়িতেই আছি। নিতুর কন্ডিশন কি এখন?'
আসিফ কাঁদছে। পুরুষ মানুষের কান্না শুনতে ভালো লাগে না! আমি কখনোই কাঁদি না। কাঁদার কথা ভাবলেই আমার বিশ্রী লাগে!
আসিফ কান্নাভেজা গলায় বললো,' ওর তো শ্বাস কষ্টের সমস্যা ছিল, এই জন্য অবস্থা বেশি খারাপ। অক্সিজেন দেয়া হয়েছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ভাইয়া! নিজেকে অসহায় লাগছে বড়!'
আমি ওকে কীভাবে সান্তনা দিবো? ফোন রেখে দিলাম।চোখ কেমন জ্বলছে আমার! কেন জ্বলছে? বাতাসটা উষ্ণ বলে? হাত দিলাম চোখে।চোখ ভেজা। টপটপ করে চোখের জল নিচে গড়িয়ে পড়ছে। আমি কাঁদছি।কান্না পছন্দ না করা এই আমিই আজ কাঁদছি আমার বোনের জন্য। আমার নিতুর জন্য!
'
হসপিটালে গিয়ে একেবারেই বোকা ভনে গেলাম। আমার বোন মৃত্যুর প্রহর গুনছে,আর ওর শাশুড়ি ননদেরা আমায় এসে খাবলে ধরেছে।আসিফের বড় বোন আমার কলার টেনে ধরে বললো,' তোরা আসলেই ছোটলোক! তোর বোন আমাদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য বিষ খেয়েছে।তোর সাথেও কি পরামর্শ করেছিল নাকি আগেভাগে? ভাই বোন মিলেই এই চক্রান্ত করেছিস নাকি?'
আমি আহত গলায় বললাম,' ছিঃ আপু,এসব কি বলছেন আপনি? একটা মানুষ মরে যাচ্ছে,আর আপনারা এখন এসব নোংরা নোংরা কথা বলছেন!'
আসিফের মা বললো,' কোনমতে বেঁচে যাক শুধু, সঙ্গে সঙ্গে তালাক হবে।'
আমি ওদের কারোর সঙ্গেই কথা বললাম না। আসিফকে দেখলাম খুব ছুটাছুটি করছে। সেই একমাত্র কষ্ট পেয়েছে নিতুর জন্য।সেই পরিশ্রম করছে।আর সবাই রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে আছে।
আমি আসিফকে নিয়ে যেতে চাইলাম নিতুর কাছে। কতৃপক্ষ বললো, এখন যাওয়া যাবে না। নিষেধ।
আমি দায়িত্বরত একজনের কাছে জিজ্ঞেস করলাম,' ওর অবস্থা কেমন এখন?'
দায়িত্বরত ব্যক্তি বললেন,' বিষ বেশি খেয়েছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে অনেক বেশি।আপনারা দোয়া করতে থাকুন। আল্লাহ যদি বাঁচিয়ে দেয় তবেই বাঁচবে।আমরা শুধু শুধু আশা দিবো না!'
আসিফ আমায় জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।ফর্সা , সুদর্শন আসিফকে কাঁদতে দেখতে আমারও খারাপ লাগছে! আমার নিজেরও কান্না পাচ্ছে । কিন্তু আমি কাঁদলাম না। এখন নিজেকে শক্ত রাখার সময়।আমি শক্ত না হলে কীভাবে কি হবে!
'
অজু করেছি হসপিটালের মসজিদের সামনের পুকুরে। তারপর পকেট থেকে টুপি বের করে মাথায় দিয়েছি।নফল নামাজ পববো।জয়া ফোন করেছে আবার। রিসিভ করলে সে বললো,' নিতুর অবস্থা কেমন এখন? একটু ভালো কী?'
আমি বললাম,' বুঝতে পারছি না কি হয়! '
জয়া বললো,' ঠিক হয়ে যাবে। কিচ্ছু হবে না। তুমি অত টেনশন করো না।কি করো তুমি? আজ কি এসে পড়বে?'
জয়ার আক্কেল কি কম নাকি? এমন অবস্থা রেখে আমি চলে যাবো কি করে?
আমি বললাম,' না আমি আসবো না। সকাল সকাল শুয়ে পড়ো।আর দোয়া করো নিতুর জন্য।'
জয়া বললো,' আচ্ছা।'
ফোন রাখতেই দেখি দূর থেকে আসিফ আমায় ডেকে ডেকে এদিকে দৌড়ে আসছে। ওকে এভাবে দৌড়ে আসতে দেখে আমার ভেতরটা কেঁপে উঠলো ভীষণ।মাথা কেমন চক্কর দিয়ে উঠেছে। আমার মনে প্রশ্ন জাগলো।প্রশ্নটা বড় ভয়ের। নিতুর কি কিছু হয়েছে?
রাত যায় দিন যায় ২য় পর্ব অনন্য শফিক
আসিফ আমার কাছে এসে হাঁটুতে ভর দিয়ে হাঁফাতে শুরু করলো। হাঁফাতে হাঁফাতে বললো,' ভাইয়া আপনার নম্বর বিজি। অনেক বার ডায়েল করেছি। একজন নার্স আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়।খুব নাকি ইমার্জেন্সি।নিতু সেন্স হারাবার আগে ওর কাছে নাকি কি কথা বলেছে।তা এখন আপনার কাছে সে বলতে চাচ্ছে।আমি বললাম,আমি নিতুর হাসব্যান্ড। নিতুর সবচেয়ে কাছের মানুষ। কিন্তু আমার কাছে সে কিছুই বলেনি। সে বললো, আপনার কাছে বলবে। নিতু নাকি আপনার কাছেই শুধু বলতে বলেছে।'
আমার ভেতরটা একটু হলেও শান্ত হলো। বোন আমার এখনও বেঁচে আছে তবে!আমি তো ওকে এভাবে আসতে দেখে ভয়ে আঁতকে উঠেছিলাম একেবারে!
আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম,' নিতুর কি অবস্থা এখন?'
আসিফ বললো,' বুঝতে পারছি না।ওরা বললো,ওরা ওদের সবটুকু চেষ্টা করছে। ভাইয়া, নিতুর অবস্থা খুব খারাপ! ওর এমনিতেই শ্বাসকষ্ট! '
আসিফ আবেগতাড়িত হয়ে গেল। ওকে দেখে মায়া লাগছে। সারাদিন রোজা ছিল। ইফতার টিফতার কিছুই করেনি হয়তো।মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।আমি বললাম,' আসিফ, তুমি গিয়ে নার্সকে বলো আমি দশ মিনিটের ভেতর আসছি।'
আসিফ চলে গেল।ও চলে যাবার পর আমি গিয়ে দু রাকাত নফল নামাজ আদায় করলাম।দু হাত তুলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলাম। বললাম,' আল্লাহ, তুমি তো সবচেয়ে বেশি দয়ালু।দয়ার সাগর তুমি! তুমি তো সব জানো। তুমি সব পারো।নিতু আমার বোন না শুধু। আমার কলিজার টুকরো। আল্লাহ, প্রয়োজনে আমার হায়াত ওকে দিয়ে দাও তুমি। তবুও ওকে বাঁচিয়ে রাখো। ওকে সুস্থ করে দাও।'
দোয়া শেষ হলে হসপিটালের দিকে এলাম আমি।আসিফ এখানে নাই।কি আনতে যেন বাইরে গেছে। ততোক্ষণে ওর চাচী মামীরাও এসেছে। আমাকে দেখে ওর বড় বোন আবার আমার সামনে এলো।এসে কর্কশ গলায় বললো,' তুমি কই ছিলা?'
আমি বললাম,' বাইরে ছিলাম।কাজ ছিল একটু।'
ও এবার গর্জে উঠে বললো,' বোন মারা যাচ্ছে আর তোমার বাইরে কাজ থাকে তাই না? আসলে উদ্দেশ্যটা কি তোমার বল তো আমায়? তুমি কি ভাবছো আমরা কিছু বুঝি না? আমরা এখনও বাচ্চা? বিছানায় মু*তি? সব বুঝি। তুমি চায়তেছো তোমার বোনটা মরেই যাক।মরলেই তোমার লাভ।মরে গেলে তোমার দুইভাবে লাভ।এক নম্বর লাভ হলো, তোমার বোন মরে গেলে বাপের রেখে যাওয়া সব সহায় সম্বল,ব্যাংক ব্যালেন্স,ঘর বাড়ি সবকিছুই তোমার।দুই নম্বর লাভ হলো আমাদেরকে শিক্ষা দিবা। মামলা খাটাইবা। আমাদের থেকে টাকা খাইয়া সেই মামলা তুলবা। বোনের মৃত্যুর মাধ্যমে বিরাট ফায়দা হাসিল করবা!'
এরিমধ্যে আসিফ এলো। সে এসে কিছুটা শুনতে পেলো।শুনে বললো,' ছিঃ আপা! তুই এই রকম বাজে বাজে কথা বলছিস কেন?'
আসিফের বড় বোন ওর গালে এক থাপ্পর বসিয়ে দিলো। দিয়ে বললো,' আমি আগেই বলেছিলাম।মা-ও বার বার বলেছে, এই মেয়ে দিয়ে সংসার হবে না।এর কোনদিন বাচ্চা কাচ্চা হবে না। মাঝখানে অনেক ঝামেলা হবে।তুই বললি নিতুর মতো লক্ষ্মী মেয়ে হয় না। ওকে ছাড়বি না তুই!তুই তার প্রতি দূর্বল।বউয়ের সাথে তোর উথালপাথাল প্রেম-ভালোবাসা। এখন মজা বোঝ!'
আসিফ কোন প্রতিবাদ করলো না। পুরুষের কোমলতা খুব খারাপ জিনিস।এর পরিণাম কখনোই ভালো হয় না!
আসিফ বললো, 'ভাইয়া, আসুন নার্সের কাছে যাই।'
আমি বললাম,' চলো যাই।'
আমরা হেঁটে হেঁটে ওদিকে যাচ্ছি।নার্সের কাছে। এরিমধ্যে আবার জয়া কল করেছে।আমি ফোন রিসিভ করে বললাম,' ঘুমাওনি এখনও?'
সে বললো,' না।ঘুম ধরে না। নিতুর কি অবস্থা?'
আমি বললাম,' ভালো না। আল্লাহ জানেন কি হয়! '
জয়া বললো,' ঠিক হয়ে যাবে। তুমি কি আজকে আসবা? '
আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। একটু পর পর কল করে সেই একই কথা! আসবা? তুমি কি আজকে আসবা?
আমার বোন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে।আর আমি নাকি বাসায় চলে যাবো ওকে এখানে ফেলে রেখে!
আমি রাগ দেখালাম না।হতেও তো পারে সে একা ভয় পাচ্ছে! একটা বাচ্চা মেয়ে নিয়ে একা এক ঘরে থাকলে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক।
আমি বললাম,' জয়া, তুমি কি ভয় পাচ্ছো?'
জয়া বললো,' আরে না! আমি কি ভীতু নাকি? আচ্ছা থাকো। এখন রাখি।'
জয়া ফোন রেখে দিলো।
ততোক্ষণে আমরা নার্সের কাছে এসে পড়েছি।কম বয়সী মেয়ে। নিতুর সমান হবে বয়স।চেহারাও খানিকটা মিল আছে ওর সাথে। নাকি নিতুকে নিয়ে বেশি বেশি ভাবছি বলে যাকেই দেখছি তাকেই নিতু মনে হচ্ছে? কি জানি!
নার্স মেয়েটিকে বললাম,' আমি নিতুর ভাই।বড় ভাই।আমিই তার অভিভাবক।আমায় বলতে পারেন ও যা বলেছে।'
নার্স মেয়েটি বললো,' আমি বলবো। আপনার কাছেই শুধু বলবো। নিতুর হাসব্যান্ডকে কাইন্ডলি এখান থেকে যেতে বলুন।'
আমি আসিফকে হাতে ইশারা করলাম।আসিফ দূরে সরে গেল।
নার্স মেয়েটি গলার স্বর নামিয়ে বললো,' আপনার বোনকে কেউ একজন রেপ করার চেষ্টা করেছিল। আপনার বোন শিকার হতে গিয়েও কোনমতে বেঁচে গিয়েছিল। এই বিষয়ে সে তার হাসব্যান্ডকে বললে তার হাসব্যান্ড নাকি বলেছে তাকে চুপ থাকতে। নয়তো মান সম্মান যাবে। মানুষ মুখে থুথু দিবে। এইটুকুই আমি জানি। হয়তো এরকম কোন কারণেই সে বি*ষ খেয়েছে।সেন্স যখন ছিল তখন আমায় বলেছে।আপাতত আপনি এই বিষয়টা গোপন রাখেন। আল্লাহ আল্লাহ করুন। আগে বোন সুস্থ হয়ে উঠুক। এরপর এসব নিয়ে অনেক কথা বলা যাবে।'
আমি চমকে উঠলাম শুনে। এরকম কিছু শুনার জন্য কখনোই প্রস্তুত ছিলাম না। ভাবিওনি কখনো এরকম কিছু হতে পারে।
আমি বললাম,' কে এরকম করতে চেয়েছিল? নাম বলেনি নিতু।'
নার্স মেয়েটি বললো,' নাম বলার আগেই তার কাঁপুনি উঠে। শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। মুখে মাস্ক দেয়া হয়।'
আমি অস্থির হয়ে উঠেছি! নিতু এরকম একটা ঘটনার শিকার হয়েছে আর আসিফ ওকে বলেছে চুপ থাকতে? নিতু তার স্ত্রী।স্ত্রীর সাথে এরকম একটা অনাচার হয়ে গেল আর সে কীভাবে বলতে পারলো চুপ থাকার কথা!
যে এই কাজ করার চেষ্টা করেছে সে নিশ্চয় দূরের কেউ না। অবশ্যই আসিফদের নিজেদের কেউ। কিন্তু এই নিজেদের কেউটা আসলে কে?
আসিফকে আমি এক্ষুনি জেরা করতে পারতাম। কিন্তু এই মুহূর্তে এসব নিয়ে কথা বলা সমীচিন হবে না। সবকিছুরই একটা নির্দিষ্ট সময় আছে।সময় এলেই আমি জেরা করবো।জেরা না শুধু এর জবাব আমি ওর কাছ থেকে কড়ায় গন্ডায় হিসেব করে নিবো। আপাতত আমাকে নিরব থাকতে হবে। আমার বোনকে আগে সুস্থ করে তুলতে হবে।
'
আমি বেরিয়ে আসার পর আসিফ আমার কাছে এলো। তারপর কোমল গলায় বললো,' ভাইয়া,আমার মা- বোন খুবই অশৃঙ্কল।ওদের রাগ বেশি,জ্ঞান বুদ্ধি কম। আপনি ওদের আচরণে কিছু মনে করবেন না প্লিজ! আমি ক্ষমা চাইছি ওদের এমন আচরণের জন্য!'
আমি আসিফের সঙ্গে তেমন কথাই বললাম না। এই আসিফের জন্য একটু আগেও আমার মায়া হয়েছিল।ও খায়নি বলে আমার কষ্ট লেগেছিল। এখন আর এরকম লাগছে না।ওর সঙ্গে কথা বলতেই আমার ইচ্ছে করছে না।
'
খুব ক্লান্তি এসে ভর করেছে আমার শরীরে। ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির হয়ে পড়েছি আমি। ভাবলাম হোটেলে গিয়ে একটা কিছু খেয়ে আসতে হবে। নয়তো আমি নিজেও রোগী হয়ে যাবো। তখন আমায় নিয়ে টানাহেঁচড়া করবে কে?
হোটেলে যাচ্ছি। আসিফকে বললাম তুমি থাকো। যেকোনো সময় প্রয়োজন হতে পারে।
আসিফ রইলো।আমি হোটেলে গিয়ে বসলাম। রুটি আর ঝাল কিছু দিতে বললাম। হোটেল বয় রুটি আর ঝোল জাতীয় কিছু একটা এনে দিয়েছে।আমি ঝোল দিয়ে রুটি মাখাতে যাবো এরিমধ্যে আবার ফোন করেছে জয়া। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শোনা গেল জয়া বলছে,' শুনো, ঝিঁঝির বাবা আজ আসবে না।'
আমি অবাক হলাম। এই কথা আমায় বলছে কেন জয়া? আমি বললাম,' জয়া, তুমি কি অন্য কাউকে ফোন করেছিলে নাকি?'
জয়া বললো
রাত যায় দিন যায় ৩য় পর্ব অনন্য শফিক
জয়া বললো,' এই, তোমারে ফোন দিয়ে ফেলছি নাকি আবার? ভুলে দিয়ে ফেলছি। মাকে ফোন দিতে গিয়ে তোমার নম্বর ডায়েল করে ফেলছি! একটু আগেও মার সঙ্গে কথা হলো।মা টেনশন করছেন আমি একা বলে। বললেন, তোমার থেকে জেনে জানাতে তুমি বাসায় ফিরবে কি না।'
আমি বললাম,'ও আচ্ছা। মাকে বলো টেনশন করার কিছু নাই। বাসার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো! কিচ্ছু হবে না। তাছাড়া নিতু একটু সুস্থ হলে তো আমি ফিরছিই!'
জয়া বললো,' আচ্ছা। তুমি কি কিছু খেয়েছো? '
আমি বললাম,' খাচ্ছি।'
' নিতুর আপডেট কি?'
আপডেট কি আমি আসলেই জানি না।আমি কোন কিছু না ভেবেই বললাম,' নিতু সুস্থ হয়ে যাবে।'
জয়া বললো,' শুনে শান্তি পেলাম। এতোক্ষণ মনের ভেতর কেমন অস্থিরতা কাজ করছিলো! আল্লাহ ওকে ভালো করে দিন।'
আমি বললাম,' রাখি।পরে কথা হবে।'
জয়া বললো,' আচ্ছা রাখো।'
জয়া তার কথায় এতো তাড়াহুড়ো করে কেন? আমি বুঝতে পারি না। আমি মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। কথা বললে বোরিং লাগবে, এরকম ভেবে হয়তো তাড়াহুড়ো করে কথা শেষ করতে চায়!
রুটি খেতে খেতে মার কথা ভাবছি। জয়ার জন্য তার মা যেমন টেনশন করছে আমার মা যদি বেঁচে থাকতেন তবে তিনিও তো টেনশন করতেন নিতুর জন্য। আমার চেয়ে অনেক বেশি অস্থির হয়ে উঠতেন হয়তো তিনি। কাঁদতেন চিৎকার করে। এতোক্ষণে ফকির মিসকিন ডেকে কতো কি সাদকা করে দিতেন হয়তো! মা তো মা-ই। মায়ের যে কি অসীম মমতা!কোন মা কি সহ্য করতে পারে এই দৃশ্য, তার চোখের সামনে তার জন্ম দেয়া মেয়ে ছটফট করতে করতে দুনিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে?
আমার স্পষ্ট মনে আছে এখনও। নিতুর যখন জন্ম হবে তখন মার অবস্থা ভয়াবহ খারাপ । বাচ্চা উল্টো ছিল। আমরা তখন গ্রামের বাড়ি থাকি।বাবা থাকেন ঢাকায়।বাবা বাড়ি না থাকায় মাকে নিয়ে হসপিটালে যেতে দেরি হয়ে গেল। হসপিটালে ভর্তি করাবার পর ডাক্তার বললো, অবস্থা অনেক বেশি খারাপ।মা-সন্তান দুজনকে একসঙ্গে বাঁচানো পসিবল না।আরো আগে এলে হয়তো একটা কিছু করা যেতো। এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।কাকে বাঁচাবেন বলেন? বাচ্চাকে না মাকে?
বাবা বললেন, দুজনকেই।
আত্মীয় স্বজনেরা বললো, মাকে বাঁচান।
মা শুধু বললেন, আমার সন্তান বাঁচুক।মা কখনোই সন্তানের জীবনের বিনিময়ে বাঁচে না। মায়ের জীবনের বিনিময়ে সন্তান বাঁচে।আমি হাসিমুখে মরতে রাজি,যদি আমার সন্তান বেঁচে থাকে।
আল্লার কি অসীম কুদরত!কারোর কোন ক্ষতি হলো না।মা এবং নিতু দুজনেই বেঁচে গেল সেবার।আজ যদি মা বেঁচে থাকতেন তবে নিশ্চয় তিনি ডাক্তারের পায়ে পড়ে বলতেন, আমার জীবনের বিনিময়ে কি আমার মেয়েকে বাঁচানো যায় না ডাক্তার বাবু!
রুটি খেতে আর ইচ্ছে করছে না। ক্ষুধা মরে গেছে। চোখের পাতা চুপসে যাচ্ছে জলে।
হঠাৎ আসিফ ফোন করলো।হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে ফোন রিসিভ করলাম। আসিফ বললো,' ভাইয়া, আপনি কোথায় আছেন?'
আমি বললাম,' বাইরে আছি। কেন? কোন সমস্যা?'
আসিফ বললো,' সমস্যা না। আপনি কতোক্ষণ পর আসবেন?'
আমি বললাম,' দশ মিনিটের মতো লাগবে।'
আসিফ বললো,' আচ্ছা ভাইয়া।'
বলে ফোন রেখে দিলো।
ও এভাবে হঠাৎ ফোন করলো কেন? আমার কেমন খটকা লাগছে। হাত ধুয়ে পানি খেয়ে বিল মিটিয়ে দ্রুত এলাম হসপিটালে। এসে দেখি থমথমে পরিবেশ।সবাই নিরব। আসিফকে ডেকে আনলাম কাছে। আমার বুক কেমন ধরফর করছে। মৃত্যুর প্রহর গুনছে যে ভাইয়ের বোন,সে ভাই শুধু জানবে এমন পরিস্থিতিতে কেমন লাগে তার!
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,'আসিফ, নিতুর কিছু হয়েছে?'
আসিফ বললো,' না। সম্ভবত একটু ভালো। একজন বললো।বললো, আগের চেয়ে কিছুটা বেটার মনে হচ্ছে।'
আমি বললাম,' আলহামদুলিল্লাহ।'
আমি তখন বাইরে এলাম। বারান্দায়। হাঁটছি। কেন যেন ভালো লাগছে আমার। আনন্দ লাগছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে আমার বোন বাঁচবেই বাঁচবে।
'
বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি।আমাকে লক্ষ্য করে একটা মেয়ে ডাকছে।হাত ইশারায়।একটু ভালো করে খেয়াল করলে বুঝতে পারলাম,ওই নার্স মেয়েটি।যার কাছে নিতু সামান্য তথ্য দিয়েছিল।যার সব আমায় বলেছিল মেয়েটি।
আমি এগিয়ে গেলাম মেয়েটির দিকে। সে আমার কাছে বললো,'আপনার বোন সুস্থ হয়ে যাবে। তার কন্ডিশন একটু ভালো বলে মনে হচ্ছে।সেন্স ফিরেনি, তবে ফিরবে। আচ্ছা খানিক আগে আপনি কোথায় ছিলেন?'
আমি সত্যিটাই বললাম। বললাম,' বাইরে ছিলাম। হোটেলে।'
মেয়েটি বললো,' আপনাদের যে আত্মীয় স্বজনেরা এসেছে। ওদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে।মে বি আপনার বোনের শাশুড়ি এবং ননদের মধ্যে। এমন অবস্থা হয়েছিল যে দুজনের মধ্যে চুলোচুলি পর্যন্ত হয়ে গেল। আমরা সবাই দৌড়ে এসেছিলাম।আমরাই থামিয়েছি ঝগড়া।'
আমি চমকে উঠে বললাম,' কি বলছেন এসব?'
মেয়েটি বললো,' হ্যা তাই তো ঘটেছে। আপনি কিছু শুনেননি?'
আমি বললাম,' না তো। তবে ওখানকার পরিবেশ থমথমে।মা মেয়ে দুজনই চুপচাপ। দুজন দুই জায়গায় দাঁড়িয়ে।আমি কিছুই বুঝতে পারিনি আসলে। তবে আসিফের ব্যবহার কেমন যেন সন্দেহজনক ছিল। সে হয়তো চেয়েছে এই ঝগড়ার বিষয়ে আমি যেন কিছুই না জানি। কোন কিছুই যেন আন্দাজ করতে না পারি।'
নার্স মেয়েটি বললো,' হয়তো।'
'
চোখে ঘুম এসে ভর করেছে। সারাদিনের ক্লান্তি জেঁকে বসেছে শরীরে। তবুও বাইরে দাঁড়িয়ে আছি । ভেতরে কোথায় গিয়ে বসবো আমি? বসার মতো জায়গা নাই। জায়গা থাকলেও ভেতরে যাওয়া যাবে না। আসিফের মা বোন ওদের কারোর মুখের দিকেই তাকানো যায় না।তাকালে কেবল মনে হয় ওরা মানুষ নয়, একেকজন বিষাক্ত সাপ। আমাকে দেখলেই ফুসফুস করে। কিন্তু সাপে সাপে কেন হঠাৎ চুলোচুলিটা হলো তার রহস্য উদঘাটন করতে পারলাম না। নিশ্চয় এখানে বিরাট এক ঝামেলা আছে।ঝামেলটা আসলে কি?
'
খানিক পর একজন মাঝবয়সী লোক এলো আমার কাছে।এসে বললো,' আমি আসিফের খালু।'
আমি বললাম,' ও আচ্ছা।'
কথা বলতে আমার একটুও ইচ্ছে করছে না।
আসিফের খালু বললেন,' এরা মানুষ না বুঝলেন! কতোক্ষণ আগে মা মেয়ে মিলে মারামারি করলো সবার সামনে।কি লজ্জার কথা! মা তার মেয়ের চুল ধরে টেনে বলতেছে,তুই দায়ী এইসবের জন্য।তোর কাছেই সব খেলা।
মেয়ে বলতেছে, তুই পাগল হয়ছিস বুড়ি।চুপ কর, নাইলে চুপ করাই দিবো জন্মের জন্য।তোর জন্য মান সম্মান সব যাবে।
তারা হসপিটালে চিৎকার চেঁচামেচি কইরা এইসব বইলা খুউব মান সম্মান রক্ষা করতেছে।'
আসিফের খালু তিরষ্কার ভরে কথাগুলো বললেন। আমি কিছুই বললাম না।চুপ করে রইলাম। কিছু লোক আছে অকারণে এসে কাতির জমাতে চায়।এক পক্ষের কথা অন্য পক্ষে গিয়ে পৌঁছে দেয়। ঝগড়া ঝামেলা বাঁধাতে এরা বিরাট উস্তাদ। এই লোকের আচরণ দেখে তাকেও এরকম মনে হচ্ছে।
খালু আমার থেকে কোন রকম সাড়া না পেলেও নিজ থেকেই আবার কথা বলতে শুরু করলো। বললো,' বাবাজি, আপনার বোন বড় ভালো মেয়ে ছিল। এই রকম একটা মেয়ে যে কেন বিষ খায়লো বুঝতে পারলাম না! তবে আমার বিশ্বাস আপনার বোনের বিন্দুমাত্র দোষ নাই। আপনার বোন দোষ করার মতো মেয়ে না।আমি মানুষ চিনি। মানুষ চিনতে আমার ভুল হয় না।একটু আগে এদের মা মেয়ের ঝগড়া দেইখা মনে হইলো আসল সমস্যা এদের মা মেয়ের মধ্যে।মেয়েরে বেশি আমার সন্দেহ লাগে।এর মুখ সাপের মতো।সব সময় ফুসফুস করে।চালাক চতুরও বেশি। বি*ষ যে আপনার বোন কেন খায়ছে এই কথা এখন পর্যন্ত কেউ জানে না। তাদের কাছে জিজ্ঞেস করলে তাদের মা মেয়েও কিছু বলতে পারতেছে না।তারা নাকি বিসমিল্লাহ বলতে কিছু জানে না।বি*ষ খাওয়ার পর যখন বমি করতে শুরু করলো এরপর থেকে কাহিনী জানে।আগের কিছু জানে না। আসিফের কাছে জিজ্ঞেস করলে সে বলে সেও জানে না। সে জানে গাড়ি করে হসপিটাল নেয়া থেকে।কেউ জানে না, কোন কারণ নাই, আপনার বোন এমনে এমনে বি*ষ খাইয়া ফেলছে এইটা বললেই আমি বিশ্বাস করবো? এক কুটি টাকা দিলেও বিশ্বাস করবো না।আমরার ঈমান ধর্ম আছে। বিবেক বুদ্ধি আল্লাহ দিছে।'
আমার খুব বিরক্তি লাগছে।কারোর সাথে কথা বলতে, কথা শুনতে আমার ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া এই লোক কথা বলে অনেক বেশি। তবে আমি ঠিকই অনুমান করতে পারছি নিতুর সঙ্গে যে এরকম করতে চেয়েছিল সে দূরের কেউ না। একটা বাড়িতে গিয়ে দূরের কেউ এই কাজ করার সাহস করবে না।যেতেও পারবে না ধারে কাছে। তাছাড়া দূরের কেউ হলে আসিফ কখনোই চুপ থাকতো না।নিতুকেও চুপ হয়ে যেতে বলতো না।যে লোক এমন কাজ করতে চেয়েছিল সে খুব ঘনিষ্ঠ হয়তো। আসিফ এই জন্যই নিজেও চুপ হয়ে গিয়েছিল এবং নিতুকেও চুপ থাকতে বলেছিল।সব জানা যাবে। শুধু নিতু সুস্থ হয়ে উঠলেই জানা যাবে। ততোক্ষণ আমাকে অপেক্ষা করে যেতে হবে।
আসিফের খালু আমতা আমতা করে বললো,' বাজান, সিগারেট খান আপনি?'
আমি বললাম,' না।'
'ওহ।'
বলে মুখ বিরষ করে চলে গেলেন খালু।আমি বুঝতে পারলাম এতোক্ষণ যে তিনি এই অনেকগুলো তথ্য দিলেন আমার কাছে এর উদ্দেশ্য নিতু খুব ভালো মেয়ে, নিতুকে তিনি খুব মায়া করেন এই জন্য না। উদ্দেশ্য একটা সিগারেট প্রাপ্তি। আমার সত্যি সত্যি হাসি পেলো। আমাদের দেশটা এরকম এক দেশ, এখানে একটা মানুষকে মাত্র একটা বিড়ি দিয়েও কিনে ফেলা যায়!
'
সেহেরির সময় হয়ে এসেছে। শহরের মসজিদে ডাকাডাকি হচ্ছে।এখান থেকেও শোনা যাচ্ছে।
এরিমধ্যে একজন এলো আমার কাছে। তার মুখ কেমন মলিন। তবে তাকেই বোঝা যায় এখানকার দায়িত্বরত কেউ। আলাদা ইউনিফর্ম আছে।এসে বললো,' যে মহিলা বিষ খায়ছিলো আপনি কি তার ভাই নাকি?'
আমি বললাম',জ্বি, আমি তার ভাই।'
সে বললো,' আপনার বোনের জ্ঞান ফিরেছে।'
রাত যায় দিন যায় ৪র্থ পর্ব অনন্য শফিক
নিতুর কাছে যাবার জন্য যখন পা বাড়ালাম তখন দ্রুত হেঁটে আমার থেকে এগিয়ে গেলো আসিফের বোন। আমার আগে সে যাবে ।যে করেই হোক যাবেই।
নিতুকে যে কেবিন দেয়া হয়েছে এই কেবিনের দরজার কাছে গিয়ে আমি আগে ঢুকতে চাইলে আসিফের বোন বললো,' তুমি পরে আসো।আমি গিয়ে দেখি ওর কোন প্রয়োজন হয় কি না। মেয়ে মানুষের কাছে আগে মেয়ে মানুষ যাওয়া ভালো।'
হঠাৎ ওর আচরণ এরকম সুন্দর হয়ে গেল কি করে? বিষয়টা আমার কাছে মোটেও সুবিধার মনে হয়নি।আমি জানি ও কেন আগে যেতে চায়!
আমি বললাম,' আপনি পরে আসুন।নিতু আমার সঙ্গে কথা বলবে। সে-ই খবর পাঠিয়েছে আগে আমার কাছে।'
আসিফের বোনের গলায় তেজের দেখা মিললো। সর্বগ্রাসী তেজ। সে ধারালো গলায় বললো,' বোন বিয়ে দিছো কাজ শেষ। এখন এসে নাক গলাও কেন? কোন অধিকারে? নিতু আমাদের বাড়ির বউ। সুতরাং, তার সঙ্গে কে আগে দেখা করবে কে দেখা করবে না তা আমরা বুঝবো। তুমি তো এইসব নিয়ে মাথা ঘামাবার কেউ না! তুমি আসছো ভালো কথা। বোনের বিপদের কথা শুনলে ভাই আসবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে এসে তুমি হর্তাকর্তা হয়ে যাবা এটা তো মেনে নেয়া যাবে না।এখন যা বলছি তা করো। বাইরে গিয়ে দাঁড়াও।আমি দেখা করে এলে মা গিয়ে দেখা করবে। আসিফ দেখা করবে। আমার আত্মীয় স্বজনেরা দেখা করবে। এরপর তুমি দেখা করবা।'
আমার মেজাজ সহজে খারাপ হয় না।আমি কোমল মনের মানুষ। কিন্তু অনৈতিকতা এবং অনাচার আমার অপছন্দের। কোথায় রাগ দেখাতে হবে এবং কোথায় কোমল হতে হবে তা আমি জানি।আমি তাকে পাশ কাটিয়ে আগে ভেতরে ঢুকলাম।ঢুকে ওর মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিতে দিতে বললাম,' যদি, এর সঙ্গে আপনার কোন রকম সম্পৃক্ততা পাই তবে আপনাকে আমি চৌদ্দ শিকের ভেতর ঢুকিয়ে ছাড়বো। মনে রাখবেন কথাটা !'
দরজা আটকে যখন নিতুর কাছে এলাম ওকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। ওর চেহারা কেমন বিবর্ণ হয়ে গেছে।চোখ জোড়া কেমন ঘোলাটে দেখাচ্ছে । বারো মাস রোগ থাকলে একটা মানুষকে যেরকম দেখায় তাকেও এরকম দেখাচ্ছে।
আমাকে দেখেই নিতু হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। কিন্তু তার কান্নার খুব একটা শব্দ হলো না। গলায় শক্তি নেই।তেজ নেই। শরীর অনেক বেশি দূর্বল হয়ে গেছে।
আমি নিতুর শিয়রে গিয়ে বসলাম।ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আদুরে গলায় বললাম,' এমন কাজ কীভাবে করলি তুই? এমন কাজ কেউ করে নিতু? তোর যদি কিছু হয়ে যেতো!'
নিতু তার দূর্বল হাত দিয়ে আমার মুখে ছুঁয়ে দিলো। ভাইয়ের স্পর্শ নিলো। তারপর জলে ভেজা চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,' আমার সঙ্গে এতো বড় একটা অনাচার হয়ে গেল,আর আসিফ বললো চুপ হয়ে যেতে। সে সময় মতো এর বিচার করবে। এখন নাকি এসব নিয়ে কথা বললে তার বোনের সংসার ভাঙবে!'
নিতুর গলায় রাগের দেখা মিললো।রোগা নিতুকে এখন মনে হচ্ছে ও হিংস্র।
আমি বললাম,' কি হয়েছিল সব বলতো ভেঙ্গে।'
নিতু চুপ হয়ে গেল। সে বলতে পারছে না।
আমি বললাম,' কোন সমস্যা নিতু?'
নিতু বললো,' তোমার কাছে আমি বলতে পারবো না। আরেকজন মেয়ের কাছেই শুধু এইসব কথা বলা সম্ভব।'
আরেকজন মেয়ে আমি কোথায় পাবো? জয়াকেও তো এখানে নিয়ে আসিনি। হঠাৎ মনে পড়লো নার্স মেয়েটির কথা।আমি বললাম,' নিতু,ওই যে নার্স মেয়েটি,ওর কাছে বলা যাবে?'
নিতুর চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে এই মেয়েকে সে বিশ্বাস করবে কি না এই দ্বিধায় ভুগছে!
আমি বললাম,' ওর সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। ভালো মেয়ে।কথা লুকিয়ে রাখবে।'
নিতু রোগা গলায় বললো,' বলো ওকে।'
আমি উঠে যাবো এর আগেই ডাক্তার এলেন।কম বয়সী ডাক্তার। খুবই সুদর্শন। এসে বললেন,' রোগীর সঙ্গে কথাবার্তা কম বলাই ভালো। আপাতত ইনি রেস্ট করুক। বিরক্ত করবেন না তাকে প্লিজ!'
আমি বললাম,' জ্বি , আচ্ছা।'
ডাক্তার বললেন,' আপনাদের দুজনের চেহারায় অনেক মিল।আপনারা কি ভাই বোন?'
আমি বললাম,' জ্বি।'
ডাক্তার মৃদু হাসলেন। হেসে বললেন,' আপনার বোন যখন সেন্স হারিয়েছিলেন তখনও বার বার ভাইয়া ভাইয়া করছিলেন।সেন্স ফেরার পরেও প্রথম যে শব্দ উচ্চারণ করলেন,তাও ভাইয়া।বোনেরা ভাইয়ের প্রতি এতো মায়া রাখে আমার জানা ছিল না। আমার কোন বোন নেই।বড় আফশোস হচ্ছে!'
অল্প বয়সী ডাক্তারের কথা শুনে আমার বড় ভালো লাগলো। এতো বড় ডাক্তার, কিন্তু কি নম্র ব্যবহার তার।
ডাক্তার অল্প সময় নিতুকে দেখলেন।কি কি যেন পরীক্ষা করলেন। তারপর নিতুকে সাহস দিলেন। বললেন,'ভয় নেই।এক সপ্তাহ থাকতে হবে এখানে। সুস্থ হয়ে যাবেন।'
ডাক্তার উঠে যাবার সময় আমায় ডেকে একটু নিতুর থেকে দূরে নিয়ে গেলেন। তারপর বললেন,' কিডনিতে ইফেক্ট পড়েছে।এটা তাকে সারা জীবন ভোগাবে। তবে বেঁচে আছে এটাই তো আলহামদুলিল্লাহ।আর আল্লাহ চাইলে এই সমস্যাও দ্রুত কেটে যেতে পারে। ভয়ের কিছু নেই। তবে সচেতন থাকতে হবে।'
আমি বললাম,' অবশ্যই সচেতন থাকবে। একবার ভুল করেছে।আর কখনো ভুল করবে না।'
ডাক্তার মৃদু হাসলেন। বললেন,' আসি।'
তিনি চলে গেলেন। বয়সে আমার চেয়ে ছোট হবেন। কিন্তু তার প্রতি আমি ভীষণ মুগ্ধ হলাম।মন থেকেই তার প্রতি দোয়া এলো।
'
কেবিন থেকে বের হবার সময় দেখি ওখানে আসিফ দাঁড়িয়ে আছে। পাশে তার বোন। তার মা।আমি বের হতেই ওরা ঢুকতে চায়লো।আমি ওদের দিকে চোখ রগরিয়ে বললাম,' যদি কেউ এখানে প্রবেশ করে তবে আমি ধরে নিবো নিতুর বি*ষ খাওয়ার পেছনে সে দায়ী।আসিফ যদি এটা করো তবে তোমাকেও দায়ী করবো।অবশ্য যতোটুকু জানি তুমি ধোয়া তুলসী পাতা না। তোমাকে আমি সহজে ছাড়বো না।যদি নিজের মঙ্গল চাও এখান থেকে ভালোই ভালোই কেটে পড়ো। দূরে দূরে থাকো।ওর কাছে আপাতত কেউ ঘেঁষবা না।'
বলে ওদের সাবধান করে আমি নার্স মেয়েটিকে খুঁজে বের করলাম। তারপর তাকে অনুরোধ করে নিয়ে গেলাম নিতুর কাছে। ওকে নিতুর কাছে রেখে আমি বেরিয়ে এলাম। তারপর আমি বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম।ওরা অনেক সময় ধরে কথা বললো।কথা শেষ হলে মেয়েটি যখন বেরিয়ে এলো তাকে নিয়ে আমি খানিক দূরে সরে গেলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম,কি বলেছে।
মেয়েটি বললো,' এমন সব কথা বলেছে যা শুনলে আপনি চমকে যাবেন!'
আমি বললাম,' বলুন সমস্যা নাই।'
নার্স বললো,' আপনার বোনের যে বেবি হয় না এই সমস্যা কিন্তু আপনার বোনের না। সমস্যা ওর হাসব্যান্ডের। অনেক বার টেস্ট করিয়েছে। রেজাল্ট সেইম। সমস্যা ওর হাসব্যান্ডেরই। আসিফের ঘর সংসার করলে কোনদিন বাচ্চা কাচ্চা হবে না তা জানার পরেও হাসিমুখেই সংসার করছিলো আপনার বোন। কাউকে কিছুই বুঝতে দেয়নি। কিন্তু কোন ভাবে এটা জেনে গিয়েছিল ওদের ঘরের লোকেরা। এই কথা আসিফের বোন জামাইয়ের কান পর্যন্ত পৌঁছে। তিন চারদিন আগে তার বোন আর বোন জামাই বেড়াতে এসেছিল।তো গত পড়শু দুপুর বেলা আসিফের বোন আর মা পাশের বাড়িতে ওদের এক চাচীর অসুখতাই তাকে দেখতে গেল। আসিফ তখন দোকানে।নিতু বাসায় ছিল।আর বোন জামাই ছিল।তো বোন জামাই তার কাছে গিয়ে বলতেছে,নিতু তোমার বিষয়ে তো সব শুনলাম।শুনে কষ্ট লাগলো। এইভাবে তো থাকার কোন মানে হয় না।বাচ্চা কাচ্চা ছাড়া কোন জীবন আছে নাকি?
তারপর নাকি খারাপ কিছু ইঙ্গিত করলো। নোংরা কথা বললো। এবং চেষ্টা করলো রে*প করার।নিতু বুদ্ধি খাটিয়ে সঙ্গে বাথরুমে ঢুকে পড়ে এবং দরজা আটকে দেয় । ভাগ্য ভালো এর খানিক পর আসিফের বোন আর মা এসে পড়ে ।ওর বোন জামাই ততোক্ষণে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।আর ফিরেইনি। নিজের বাসায় চলে যায়। সে রাতেই নিতু আসিফকে বলে সবকিছু।আসিফ বলে ওকে চুপ থাকতে আপাতত।পরে সময় করে এর শোধ নেবে।শাস্তি দিবে। এখন তার ভাগ্নে -ভাগ্নী বড় হয়ে গেছে।বড় ভাগ্নী বিয়ের উপযুক্ত। তাছাড়া বোন জামাই গত বছর হজ্জ থেকে এসেছে। এসব যদি বাইরের কেউ শুনে মান সম্মান থাকবে?
নিতু এটা মানতে পারেনি। পরদিন সকাল বেলা আসিফের বোনের কাছে সব বলে। আসিফের বোন উল্টো রেগে যায় তার প্রতি।চড় থাপ্পড় দেয়। ধমকাধমকি করে বলে,নিজে তো বন্ধ্যা মেয়ে।বাচ্চা কাচ্চা হবার নাম নাই। তোমার চরিত্র আমি জানি না কেমন খারাপ! তুমি আমার জামাইরে বিরক্ত করছো। তুমি তারে বাজে ইশারা ইঙ্গিত করছো।তারে গলাতে পারোনি এখন আসছো আমার কাছে নালিশ নিয়া। আমার ঘর সংসারের প্রতি নজর লাগছে তোমার। আমার সোনার সংসার ভাঙতে চাও তুমি!
তার শাশুড়ি এখানেই ছিল।তিনিও নিতুকে বললেন এইসব ভুল বোঝাবুঝি।যা হয়েছে হয়েই গেছে।বললে তো আর ফিরবে না কিছু।চুপ থাকায় ভালো। মানুষ শুনলে হাসবে। কাউকে মুখ দেখানো যাবে না!
নিতু সঙ্গে সঙ্গে আসিফকে ফোন করে। তার বোন তাকে অপমান করেছে,উল্টো দোষ দিয়েছে এসব বলে।আসিফ তখন তাকে ধমক দিয়ে বলে, তোমাকে না করিনি এসব নিয়ে আর কথা না বলতে? বলিনি চুপ থাকতে? বেশি বুঝো! এখনও যদি চুপ না থাকো তবে তোমার যা ইচ্ছে তা করো।আমি কিছু জানি না।
নিতু সহ্য করতে পারেনি। রাগে দুঃখে অভিমানে বি*ষ খেয়েছে।'
সবকিছু শুনে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। ইচ্ছে করছিলো তখনই এদের ধরে ইচ্ছে মতো মারধোর করি। থানায় গিয়ে মামলা করি। বিশেষ করে আসিফের প্রতি আমার রাগ লাগলো বেশি।ওর এতো বড় একটা সমস্যা। আমার বোন তবুও সব জেনে শুনে তাকে মেনে নিলো।আর সে ককি করলো?
নিতুর কাছে গেলাম আবার আমি। বললাম,' এদের সবগুলোকেই আমি ধরিয়ে দিবো ।আমি এদের নামে মামলা করবো।তোর অসুখ সেরে উঠলে তোকে এখান থেকে সরাসরি আমাদের বাসায় নিয়ে যাবো। এখানে আর একদন্ড না। ওদের সঙ্গে আর কোন রকম সম্পর্ক নেই আমাদের!'
নিতু বড় কাতর গলায় বললো,' বাসায় গিয়ে কী হবে ভাইয়া? এই বাসা এখন আর আমার নিজের মনে হয় না! আমি মনে করলেও লাভ নাই।ভাবি, আমাকে সহ্য করতে পারেন না! ওখানে গিয়ে এরচেয়ে আমি খারাপ থাকবো! বাসার চেয়ে বরং আসিফদের ওখানেই ভালো থাকবো।অন্তত আসিফ আমায় শ*ত্রুর চোখে দেখবে না!'
আমি বললাম,'বোন, জয়াকে আমি বুঝিয়ে বলবো।বাসা কী আমার একার? তোরও তো।আমি বললে জয়া বুঝবে।'
নিতু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। হেসে বললো,' আমার জীবনটা একটা খেলনা হয়ে গেছে। কোথাও আমার কেউ নেই!'
আমি বললাম,' আমি আছি।তোর জীবন আবার নতুন করে শুরু হবে।অন্য রকম করে।
নিতু হাসলো না। কেমন থম মেরে রইলো।আমি ওর চোখের দিকে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ইশ্ কি যে দুঃখী দুঃখী লাগছে ওকে দেখতে! মনে মনে আমি বললাম,নিতু,তোর জীবনে আবার সুখ আসবে।তোর জীবন হবে জান্নাতের মতো। সুন্দর। সুশোভিত।
'
আমি বের হয়ে এসে বললাম,' আমার বোনের সঙ্গে এখান থেকে কেউ দেখা করতে যেতে পারবে না।কেউ না।'
আসিফ এবার কথা বললো। সে বললো,' ভাইয়া, আপনি ভুল বুঝতেছেন।নিতু আপনার কাছে যা বলেছে তা আপনি শুনে শুধু শুধু রাগ করছেন। আপনি যদি এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়তেন তবে আপনি কি করতেন?'
আমি হাসলাম । তাচ্ছিল্যের হাসি। হেসে বললাম,' সবার আগে বড় বোনের গালে দুইটা থাপ্পড় লাগাতাম। তারপর তার চরিত্রহীন জামাইরে নিজেই ফাঁ*সিতে ঝুলিয়ে দিতাম!'
আসিফ চুপ হয়ে গেল।ওর বোনের মুখ আবার খুলেছে।গতিও বেড়েছে। সে আমার সামনে এসে দাড়িয়ে চোখ গরম করে বললো,' হুমকি দিচ্ছো নাকি? তোমার বোন কি ধোঁয়া তুলসী পাতা? তোমার বোন কি গঙ্গার জল একেবারে? এক হাতে তালি বাজে? '
আমি বললাম,' আপনি মেয়ে মানুষ। নয়তো এখন দেখিয়ে দিতাম তালি কয় হাতে বাজে। বেয়াদব মহিলা কোথাকার! নিজের লম্পট স্বামীর পক্ষে সাফাই গায়তে আসছে!'
আসিফ কিছুই বলছে না। সে বোধহয় ভয় পেয়েছে।
আমি একেবারে সাফ সাফ করে বলে দিলাম,' আমরা ডিভোর্স নিবো। আমার বোন এই সংসার করবে না।আর তোমাদের শাস্তি যা হবার তা আইনি প্রক্রিয়ায় হবে।আমি মামলা করবো।'
বলে ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম। হোটেলে এসে একটা খেজুর আরেক গ্লাস পানি খেলাম তাড়াহুড়ো করে। ততোক্ষণে সেহেরির সময় শেষ হয়েছে। আজান হয়েছে ফজরের।
এর খানিক পরেই জয়া ফোন করলো । বললো,' নিতুর কি অবস্থা?'
বললাম,' ভালো ।'
এরপর জানতে চাইলো কখন ফিরবো আমি? আজ ফিরবো কি না।
আমি বললাম,' ওকে রেখে ফেরাটা কঠিন। এখানকার পরিস্থিতি বললাম।'
জয়া বললো,' থাকো। সমস্যা নাই।'
আমি বললাম,' অফিসটা নিয়ে সমস্যায় পড়েছি। প্রাইভেট জব। কখন যে জব উধাও হয়ে যায়!'
জয়া বললো,' কাউকে ফোন করে বলো।'
আমি বললাম,' দেখি কি করা যায়!'
এরিমধ্যে জয়ার হাত থেকে টেনে ফোন নিয়ে গেলো ঝিঁঝি। ফোন নিয়ে ঘুম ভাঙা মিষ্টি গলায় বললো,' বাবা,কাল রাতে একটা মামা এসেছিল। আমার জন্য অনেক চকলেট এনেছে। মামা কী করেছে জানো
চলবে...

Post a Comment
কমেন্টে স্প্যাম লিংক দেওয়া থেকে বিরত থাকুন